প্রমিথিউস
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেড় মাস গেলো। অনেকেই এই সময়ের খতিয়ান দিয়েছেন। যাঁরা বর্তমান সরকারের সমর্থক তাঁদের এই খতিয়ান শুরু হয়েছে আগের সরকারকে গালাগালি করে। আগের সরকার যেমন তাদের অসফলতা দেখানোর জন্য বিএনপি- জামাতকে গালাগাল করতো। এ এক আয়রনি; এ থেকে মুক্তি নেই যেন। নিজের দায় নিজের কাঁধে নেয়ার সাহসের এবং সততার অভাব এ সমাজে। এইটি সংস্কার করবে কে? যা হোক, বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়নে তাঁরা আরো সময় চেয়েছেন; কাজেই আরো কিছু সময় তাঁদের দেয়া যাক। আমি আজকের লেখায় এ সরকারের নারী বিষয়ক মূল্যবোধ নিয়ে কিছু কথা বলবো। এর একটি বিশেষ কারণ হলো, বর্তমান সময়ে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন এবং তাঁদের বাইরের সমর্থকগোষ্ঠী উভয়ে মিলে বাংলাদেশে আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজে যেসব পরিবর্তন আনতে চাইছেন বা আনছেন সেগুলোর সামাজিক দর্শনে নারীর অবস্থানটি আমাদের বোঝা দরকার। আমি এখানে বর্তমান সময়ের ক্ষমতার ডিসকোর্সটি আলোচনায় এটি এনেছি এর অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতাটি তুলে ধরার জন্য।
আমি প্রথম ধাক্কাটি খাই যখন দেখলাম আন্দোলনের তথাকথিত সমর্থকরা বঙ্গভবনে গিয়ে মহানন্দে লুটপাট চালালো; চরম ধরনের অসভ্যতা করলো; প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বাস প্রদর্শনপূর্বক বিকৃত আনন্দ লাভ করলো; এসবের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক পার্ভাসানের চরম প্রকাশ দেখিয়েছেন এই মানুষগুলো। আমরা এবং আমাদের আলোকিত বিশ্ববিদ্যালয় নেটওয়ার্কের নব্য ক্ষমতাবান বুদ্ধিজীবীরা চুপচাপ দেখে গেলাম। নারীত্বের অবমাননাও যেন ঠিক আছে, কারন আপনারা হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছেন, কাজেই পারভার্ট সংস্কৃতির প্রকাশ আন্দোলনের সমর্থকরা ঘটাতেই পারেন; ব্যপার না; তিনি এত মানুষকে মেরেছেন, কাজেই তাঁর অন্তর্বাস নিয়ে প্রদর্শনী চলতেই পারে; অথচ তাঁর সরকারের কোন পুরুষ ক্ষমতাবানের অন্তর্বাস নিয়ে এমনটি হয়নি; কারণ কোন ক্ষমতাবান যদি হয় “মেয়ে মানুষ” তবে “পুরুষ” দ্বারা ক্ষমতাহীন হওয়ার পর তাঁর শারীরিক নিগ্রহটাই করতে হয় সবার আগে। এইটিই ক্ষমতাহীন পুরুষ যখন ক্ষমতার মসনদে ওঠে কোন ক্ষমতাবান নারীকে পরাজিত করে তখন তার প্রথম উৎসব উদযাপন।
মিসোজিনিষ্টরা নারীর যে বৈশিষ্ঠগুলোকে বড় করে দেখে সেগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে তাদের দৈহিক সৌন্দর্য, যৌনাবেদন, স্বভাবের মিষ্টতা, এবং নম্রতা বা বৈশ্যতা বা আজ্ঞাবহ থাকার মানসিকতা। এর ব্যতিক্রম নারী সম্পর্কে তাঁদের রেটিং নামিয়ে দেয়। মোটামুটিভাবে নারী এদের কাছে সুন্দরী এবং যৌনাবেদনময়ী হওয়ার সাথে সাথে তাদের মধ্যে পুরুষের আজ্ঞাবহ থাকার মানসিকতা থাকতে হবে যেটিকে মিসোজেনিষ্টরা চরিত্রের “মিষ্টতা” বা “নম্রতা” হিসেবে দেখেন। এগুলোর ব্যতিক্রম হলেই তাদের কাছে নারী “খারাপ মেয়েছেলে” (“Bad Girl বা Woman”)। মোটামুটিভাবে নারী ক্ষমতাবান হলে তাদের মধ্যে তথাকথিত নম্রতা বা মিষ্টতা থাকেনা বা থাকবেনা এটাই স্বাভাবিক। এই মিসোজিনিষ্টদের চোখে ক্ষমতাবান নারী তখন অবশ্যই খারাপ মেয়েছেলে; তিনি শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া বা ইন্দিরা গান্ধী কিংবা মার্গারেট থ্যাচার যেই হননা কেন। তাই বলে এই খারাপ মেয়েছেলেদের প্রতি মিসোজিনিষ্ট পুরুষের যৌন আকর্ষন কমেনা; বরং এদের “খারাপত্বের” প্রতিবিধানে এই কৌশলটি প্রয়োগ করার একটা সুপ্ত বাসনা মিসোজিনিষ্টদের মনে কাজ করে। এরই ফলে ক্ষমতাচ্যুত নারীর প্রতি তাদের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় এই অবদমিত কামনা বা বাসনা। এখানে নারীর বয়স, জাত, ধর্ম ও সম্পর্ক কোন কিছুই ফ্যাক্টর নয়; তিনি একজন নারী, এই পরিচয়ই মুখ্য। এই ব্যপারটি আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে দেখেছি। শোনা যায়, বিডিআর বিদ্রোহের কালেও এটি ঘটেছিলো। এটিই ঘটার কথা ছিলো শেখ হাসিনার বেলায় যদি তিনি দেশ থেকে চলে না যেতেন; কিন্তু তিনি চলে গেলে কী হবে? অবদমিত বাসনাটি থেকে গেছে বিশ বা পঁচিশ বছরের “ক্ষমতাবান” পুরুষটির মনে যে এতদিন নিজেকে ক্ষমতাহীন ভেবেছে শেখ হাসিনার কারণে। কাজেই তিনি শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তাঁর ব্যবহৃত অন্তর্বাস হয়ে উঠেছে তাঁরই সিম্বল; এই অন্তর্বাস কোন আটাত্তোর বছর বয়সী নানী বা দাদীর নয়; এটি একজন “নারীর” যিনি পুরুষকে শাসন করেছেন লৌহদন্ড হাতে। এই প্রজাতির পুরুষদের মনের যে অবদমন সেটিরই প্রকাশ ঘটেছে সেদিন। আমার প্রত্যাশা ছিলো এই সরকারের প্রধান যাঁকে নারীর “ক্ষমতায়নের” একজন পুরোধা বলে মনে করেন অনেকে, সেই তিনি অন্তত এ কাজটির সমালোচনা করবেন। তিনিতো করেনইনি, তাঁর মন্ত্রীসভার কেউই, এমনকি তিনজন স্বনামখ্যাত নারীও করেননি।
এই যে নারীর ব্যবহার্য অন্তর্বাস নিয়ে পুরুষ বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গী সহকারে অবদমিত যৌনতার ইঙ্গিতপূর্ণ স্থূল অভিব্যক্তি ঘটায় তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে, এটিকেই প্রতীকি সহিংসতা বা Symbolic Violence বলা যাতে পারে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহার্য জিনিস নিয়ে এই যে কদর্যতা এটিই প্রমাণ করে, পুরুষের চোখে আশি আর আঠেরো বছরের নারী একই জিনিস, কেবলই একটি যৌন বস্তু (Sexual Object)। এ কারণেই আমি বলি, ক্ষমতাহীন বা ক্ষমতাচ্যুত এমনকি অনেক সময় ক্ষমতার অধিকারী নারীকে পুরুষ যৌন বস্তু হিসেবেই দেখে, এবং যখন এটিকে সমাজে স্বাভাবিক ব্যপার হিসেবে মেনে নেয়া হয়, বা যখন এই ঘটনাটিকে আন্দোলনে অংশগ্রহনকারীদের উল্লাস বা ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ন্যায্যতা দেয়া হয় তখনই নারীর শারীরিক বস্তুবাদীকরণের (Sexual Objectification) কাজটি সম্পন্ন করা হয়। এই ব্যপারটি ঘটেছে আলোচ্য ক্ষেত্রে। এখানে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নারীত্বের প্রতীকি অবমাননা বা সহিংসতা বা হিংস্রতার বিরোধীতা না করে নীরব থাকার ফলে বা “মবের আচরণদ এসব ক্ষোভের প্রকাশ ঘটতেই পারে”, বা “তারা এই অঅভ্যূত্থানের ফলাফলটি উপভোগ করছে মাত্র” এ জাতীয় বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে পুরুষ নারীর বস্তুবাদীকরণের প্রক্রিয়াটিকে ন্যায্যতা প্রদান করে। এখানটাতেই আমি আশা করেছিলাম নারীর ক্ষমতায়নের অনুমিত অন্যতম পুরুষ সহযাত্রী মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং ক্যাবিনেটের তিনজন স্বনামখ্যাত নারী অন্তত রুখে দাঁড়াবেন। আইনের আওতায় না আনতে পারলেও অন্তত তাঁরা এর বিরোধিতা করবেন— এমনটাই আমার প্রত্যাশা ছিলো তাঁদের কাছে। নারীর প্রতি এমন আচরণ এবং মনোভাব পরিবর্তন করতে না পারলে কোন সংস্কারই ফলপ্রসু হবেনা, কারণ আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। পৃথিবীর কোন দেশ নারীকে আজ্ঞাবহ বা বৈশ্যতামূলক সামাজিক সম্পর্কের জালে আবদ্ধ রেখে সত্যিকারের উন্নতি সাধন করতে পারেনি। যদি পারতো তবে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশ বলতাম। লক্ষ্য করে দেখুন, এ দেশগুলো বাইরে থেকে জনশক্তি আমদানী করে, অথচ তাদের জনসংখ্যার অর্ধেক যে নারী তারা শুধু টেকনিক্যাল বা প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রগুলোতে নয়, অন্যান্য সাধারণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতেও পুরুষের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। ইউরোপের অনেক দেশের জিডিপি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে কম, কিন্তু তাদের বাইরে থেকে জনশক্তি আমদানীর প্রয়োজন পড়েনা, কারন তাদের নারী পুরুষ উভয়েই সব ধরনের ক্ষেত্রে কর্মরত আছে।
আমি মাঝেমধ্যেই ভাবি, শেখ হাসিনা যদি শারীরিকভাবে থেকে যেতেন বাংলাদেশে যেটি তিনি চেয়েছিলেন বলে শুনেছি তবে কী ঘটতো? আমি শুনেছি শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করতে চাননি, কিন্তু সেনাবাহিনী ও তাঁর পুত্র- কন্যারা এটি মানেননি, এবং তাঁকে তাঁরাই বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তাঁকে চলে যেতে হবে; বিভিন্নভাবে তাঁকে বোঝানো হয়েছে নাকি। এক পর্যায়ে তিনি রাজী হন এবং দেশ ত্যাগ করেন। যদি না যেতেন, আমি স্থির নিশ্চিত ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নে ও বেশ কিছু সামাজিক প্যারামিটারে বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশের উত্থান বিষয়ে সর্বাধিক অবদান রাখা এই মানুষটি মৃত্যুর আগে বাংলাদেশে তাঁর ষাটোর্ধ্ব ছোট বোনসহ তথাকথিত “পুরুষ” তন্ত্রের প্রতিভূ আন্দোলনকারীদের হাতে গণনিগ্রহের শিকার হতেন। আমার ধারনা, তাঁদের গণনিগ্রহের কাজটি করা হয়ে ওঠেনি বলেই “ধার্মিক অবয়বের” পুরুষ তাঁর অন্তর্বাস প্রদর্শনের সুযোগটি অন্তত হাত ছাড়া করেনি।
ফ্রেডারিক এঙ্গেলস বলেছিলেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম নির্যাতিত গোষ্ঠীটির নামই ছিলো “নারী”। এঙ্গেলস যে কতটা সঠিক ছিলেন তা আমরা নারী দেহকে যে শুধুই যৌন চাহিদা মেটানোর বস্তু ভাবি তা থেকেই বোঝা যায়; নারীর ব্যবহার্য জিনিসপত্রও তখন আমাদের কাছে তার শরীরের সমতুল্য হয়ে যায়। এখানে নারী তার শ্রেণীগত অবস্থানকেও অতিক্রম করে যান। অনেক পুরুষের কাছেই মা, খালা, নানী, দাদী এসবের কোন অর্থ থাকেনা; নারী শুধুই নারী। শেখ হাসিনার অন্তর্বাস নিয়ে যে উন্মত্ত পারভার্সানের প্রকাশ আমরা দেখেছি এটি সেই সিদ্ধান্তকেই প্রমাণ করে। আমাদের বর্তমান সরকারের প্রধানকে কোন কোন সমাজবিজ্ঞানী বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম পথিকৃৎ মনে করেন; তো তিনি কোন প্রতিবাদ করেছেন এর? করেননিতো। তিনি নারী- পুরুষের বাইনারী অপজিশন দ্বারা সরাসরি চালিত হয়ে কাজটি করেছেন ভাবছেন না হয়ত; শেখ হাসিনার প্রতি উষ্মার কারণেই হয়ত কিছু বলেননি, কিন্তু আমার মনে হয়, পুরুষ মাত্রেই অবচেতন মনে ক্ষমতাশালী নারীর দ্বারা নিগৃহীত হলে এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে তার এমন অসম্মানকে সঠিক মনে করেন। শেষ বিচারে ভালো মানুষ পুরুষরাও পুরুষইতো যাঁরা ক্ষমতার প্রতীক, শৌর্যবীর্যের প্রতীক; কাজেই তাঁদের এমন চিন্তাও এখন আর বেঠিক মনে হয়না আমার অনেক আলোকিত বন্ধুদের। তবে ওই সময় আমার খারাপ লেগেছিলো খুব এবং আশাটা একটু ভিন্ন ছিলো। নিজে পুরুষ হওয়ার কারণেই হয়ত প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে একটু অন্য রকম আশা ছিলো। হলোনা সেটি। তাই এখন পুরুষ হিসেবে আমি লজ্জিত।
আসলে ক্ষমতাবান আন্দোলনকারীদের বিকৃতিকে সমালোচনা না করে এক ধরনের নীরব বৈধতা দেয়া হয়েছে, এবং আমার মতে, তাদের এক ধরনের ঘুষ দেয়া হলো। এইটি আমার প্রথম ধাক্কা। আমার মনে হয়েছে, এ কেমন নেতৃত্ব যেটি মানুষের সাংস্কৃতিক পারভারসানকে বৈধতা প্রদান করে? হতে পারে, এটির টার্গেট যিনি তিনি হাজার মানুষ খুনের ব্যপারে অভিযুক্ত, কিন্তু তাই বলে নারী বলেই তাঁর যে অবমাননাটি করা হলো তার বিরুদ্ধে একটি কথাও ক্যাবিনেটের প্রধান এবং পুরুষ সদস্যরাতো নয়ই, এটির তিনজন আলোকিত নারীর কেউই কিছু বলবেন না? এই নারী সদস্যদের কী সমস্যা ছিলো? ক্ষমতা হারাতেন তাঁরা? হয়তো হারাতেন, কিন্তু যে উচ্চতায় তাঁরা থাকতেন মানুষের মনে সেটি অনেক বড় হতো মন্ত্রীত্ব্বের চেয়ে।
এইটি আমার শুরুতেই মানতে অসুবিধা হয়েছে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রীয় সংস্কার করার জন্য প্রথম উদ্যোগগুলোর একটি হচ্ছে এই সমাজের নর্মেটিভ চিন্তার সংস্কার করা; বিভিন্ন সংখ্যালঘু, যেমন নারী, ধর্মীয় ও এথনিক গোষ্ঠী, ও অন্যান্য গোষ্ঠীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনটি নিশ্চিত করতে হবে এসব বিষয়ে বৈষম্য দূর করতে হলে। খেয়াল করলে দেখবেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সহযোগী হিসেবে অনেক পুরুষের বাড়ী ঘর আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু এদের অন্তর্বাস প্রদর্শনের কথা কারো মনে আসেনি, কারণ নারী পুরুষশাসিত সমাজের প্রথম “যৌন” টার্গেট; আবার এই নারী যদি কখনো ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন তবেতো আর কথাই নেই।
যে কোন সমাজের প্রগতিশীলতার মাপকাঠিগুলোর মধ্যে সবার আগে স্থান হচ্ছে সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন সেটি। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে এটি মাপা যায়না; যদি যেতো তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সবচেয়ে উন্নত বলে বিবেচিত হতো। জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন সংস্থার মিলেনিয়াম লক্ষ্যগুলোতেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। এই বাংলাদেশেও বিগত তেত্রিশ বছর দেশের সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন দু’জন নেত্রী। “স্বৈরাচারী শাসক” হিসেবে যাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে তাঁর শাসনকালে নারী ক্ষমতায়ন ঘটেছিলো বিভিন্ন সেক্টরে দৃষ্টগ্রাহ্যভাবে। এই বিশেষ ঘটনাটি বাংলাদেশ নামক দেশটিতে পুরুষের মনে নারীর প্রতি কুসংস্কারচ্ছন্ন যে মিসোজেনিক চিন্তা সেটিকে প্রতিষ্ঠা করেছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়াও কটি দেশের উন্নয়নের মাপক হিসেবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকেও বিবেচনায় নেয়া হয় আজকের যুগে যেখানে নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক অবস্থানকে গণ্য করা হয় উন্নয়নের পরমাপক হিসেবে। নারীকে যদি পুরুষের মত শুধুই একজন মানুষ হিসেবে ভাবা হয় যৌন বস্তু না ভেবে তবে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটবে দ্রুতগতিতে যেটি সামাজিক উন্নয়নে একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূর। শেখ হাসিনা নারীকে বিভিন্ন পদ পদবী দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কিছুটা কমিয়েছিলেন, কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তিনি তেমন কিছু করেননি; বরং চরম মৌলবাদী এবং নারী বিদ্বেষী ও নারীকে যৌন বস্তু হিসেবেই দেখে অভ্যস্ত মোল্লা ও মৌলবাদীদের তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন; মূলত ভোটের রাজনীতির জন্যই তিনি করেছিলেন এটি। কিন্তু আজ তাঁর এবং দেশের অবমাননা অনেকটাই ন্যায্যতা পেয়ে গেছে এ কারণেই। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে সাংস্কৃতিক মন এবং মননের সংস্কার না করলে বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন কখনোই ঘটবেনা—এইটিই নতুন উন্নয়ন প্যারাডাইমের সার কথা যা শেখ হাসিনা কেবলমাত্র বস্তুতান্ত্রিকতা দিয়ে বুঝেছিলেন, কিন্তু সাংস্কৃতিক মান বা মূল্যবোধকে খুব বেশী বিবেচনায় নেননি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন সংস্কারের জন্য, এমন ভাবার এখনো কোন কারণ ঘটেনি, বরং তাঁদের কর্মকাণ্ড অনেকটাই নারীর প্রতি মিসোজিনিস্ট ডিস্কোরসকে সমর্থন করে যাবে বলেই মনে হচ্ছে।