অভিমন্যু ফয়েজী
মোটামুটি শুরু থেকেই আমরা জানতাম কী হবে। এরা একটু সময় নিলো নিজেদের প্রকাশ করতে। ডঃ ইউনুস নিজে যা পারেননা তা তাঁর ক্যাবিনেটের দুই শিশুকে দিয়ে বলিয়ে নেন্। কারন, শিশুরাই তাঁর “নিয়োগকর্তা”, কাজেই তাদের দিয়েই কাম কাজ সারতে হয়। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম এমন একটি সময়ের যখন এই আন্দোলনটি যে রাজাকারদের ছিলো তা জলের মত পরিস্কার হবে। প্রকাশ্যে যে আন্দোলন স্বাধীনতার স্থপতির বিরুদ্ধে ছিলোনা, তাঁকে জাতির পিতা করার বিরুদ্ধে কোন প্রকাশ্য এজেন্ডা এদের ছিলোনা, রাজাকারদের ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়ে কোন বক্তব্য ছিলোনা সেই আন্দোলনের ফলাফল আজ বলে দিচ্ছে, এরা সুঁচ হয়ে ঢুকেছে ফাল হয়ে বেরুবে বলে।
ইউনুসের নিজের সাহস কম, এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত; তাঁর রিসেট বাটনে চাপ দেয়ার তত্ত্ব থেকে পিছটান দেয়ার কাহিনীও এ বিষয়টি বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। তিনি এতজন চতুর মানুষ। এই মানুষটি বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে সেরা ধূর্তমানব; শেয়াল তাঁর কাছে হার মানে; মীর জাফর, মোশতাক এরা তাঁর কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিপ্পান্ন বছর কেটে গেছে; কিন্তু ইউনুস তাঁর নিজের অবস্থান দেশবাসীর কাছে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। মোশতাক বা মীর জাফর এত সময় নেয়নি নিজেদের লুকোতে। আমার নিজের ধারনা হলো এই যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে চতুরতম রাজনীতিকের নাম ডঃ ইউনুস, মুশতাক নয়। তিনি অপরিসীম চতুরতায় নিজেকে মুখোশের আড়ালে ঢেকে রাজাকার দর্শন বা স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের প্রতি তাঁর সমর্থনকে গোপন রাখতে পেরেছেন আজ এত বছরে। বাঙ্গালী নিশ্চয়ই আজ নতুন করে ভাববে, এ কাকে তারা বিশ্বাস করেছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে?
যে দুই শিশু “শেখ মুজিবুর রহমান”কে জাতির পিতার স্থান থেকে সরানোর কথা বলছে তারা নিজেরাও একেকজন ক্ষুদে মীর জাফর ও খোন্দকার মোশতাক, এবং এদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জন্মের ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যাবে এরা কোত্থেকে উঠে এসেছে। এদের না আছে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে পঠন পাঠন, না আছে নিজ সমাজের সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে কোন জ্ঞান। এদের জানা নেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতির জনকের স্থানটি কিভাবে নির্ধারিত হয়; এরা কখনো জানেনি তাদের পিতৃভূমি পাকিস্তানের জাতির জনক কিভাবে নির্ধারিত হয়েছে; অথবা ভারতের কিংবা তাদের আন্তর্জাতিক মোড়লদের। পাকিস্তান সৃষ্টিতে অনেক মনিষীর অবদান আছে, কিন্তু এই কুলাঙ্গারদের মত জিন্নাহ বা মুসলিমলীগবিরোধী কেউ কখনো বলেননি, জিন্নাহর মত পাকিস্তানের আরো অনেক “ফাউন্ডিং ফাদার” আছেন; কাজেই জিন্নাহকে জাতির জনকের স্থান থেকে ফেলে দিতে হবে। এই গর্দভরা জানেনা “ফাউন্ডিং ফাদার” আর “ফাদার অব নেশান” এক জিনিস নয়। এদের একজন নাকি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। আমি অবাক হই এটা ভেবে যে, সমাজবিজ্ঞানে এই ফাউলের সব এলামনাইদের লজ্জা পাওয়া উচিত এই বিষয়টি তাদের পঠনপাঠনের ক্ষেত্র ছিলো বলে। সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রীধারী কেউ যদি দেশের সামাজিক ইতিহাস না জানে, রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে হ্যালাফ্যালা করে, “ফাউন্ডিং ফাদার” আর “ফাদার অব নেশান”কে এক অর্থে ব্যবহার করে, তবে তার সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রীটিকে প্রকৃত বিচারে কোন মানদন্ডেই জ্ঞান আহরনের মাপকাঠি বলা চলেনা। কে জানে, এই ছোকরা টুকে পাশ করেছে কিনা!
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, নাহিদ নামের এই নাদান সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করে বসেছে, সাত’ই মার্চের ভাষন তেমন কিছুনা! বলে কী এই কুলাঙ্গার! সাতই মার্চের ভাষনকে যে ইউনেস্কো সেরা একটি “ডকুমেন্টারি হেরিটেজ” ঘোষণা করেছে তাদের “দ্য মেমোরী অব ওয়ার্ল্ড রেজিষ্টার” নামের সংকলনে তা এই নাদানের জানা নেই। এ যা পারে তা হলো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগ বাটোয়ারায় অংশ নিতে। আর হারুনের ভাতের হোটেলে মোরগ পোলাও খেয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিতে। এর কী যোগ্যতা আছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এমন মন্তব্য করার? আমি নিশ্চিত নাহিদ এবং আসিফ এরা দু’জনই রাজাকার মতাদর্শ অনুসারনকারী পরিবারের সন্তান, কারণ এদের সামাজিকীকরন ঘটেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চিন্তাধারায়; তা নাহলে এমন মন্তব্য করার মত ঔদ্ধত্য এদের থাকার কথা নয়।
এই নাহিদ নামের কুলাঙ্গারটির আসল রাজনৈতিক গুরু যারা জামায়াত-ই-ইসলামী করেন তাঁরাও আজ পর্যন্ত এ কথা বলেননি; তবে তাঁরা বলবেন অচিরেই তা বুঝা যাচ্ছে। এর আগে বিগ্রেডিয়ার আজমীকে দিয়ে একটা মাঝারি ঢিল ছুঁড়েছিলেন তাঁরা; এরপর ইউনুসকে দিয়ে “রিসেট বাটন” নামের বেশ বড়সড় একটা ঢিল ছোঁড়া হয়েছিলো। আর এখন এই শিশুদের দিয়ে আরেকটি বড় ঢিল ছুঁড়েছেন তাঁরা। প্রথম দুটোতেই পিছটান দিতে হয়েছে তাঁদের। শেষেরটি মাত্রই এলো বাজারে। দেখা যাক এই দুই অসুর শিশুর কী অবস্থা হয় এই বাংলাদেশে। যে দেশে ত্রিশ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে আর দু’লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে স্বাধীনতা নামের এই মহান অর্জনটির জন্য; এত সোজারে, পাগলা! তোদের বাপেরা কিচ্ছুটি করতে পারেনি। আর তোরাতো কোন্ ছার! তবে বোঝাই যায়, তোরা বাংলাদেশে আরেকটি যুদ্ধ ডেকে আনছিস্। আমি নিশ্চিত যে, বাঙ্গালী জাগবে, এবং এই দুগ্ধপোষ্য রাজাকারদের এবং তাদের রাজনৈতিক পিতা, পিতামহ, আন্তর্জাতিক মোড়ল সবাইকে আবার পরাজিত করবে; গৃহযুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে এই শকুনেরা।
এই দুই শিশুকে এক্ষুনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা উচিত। যদি না করা হয় তবে বোঝা যাবে এরা যে সরকারের অংশ সেটি আমাদের সংবিধানের লঙ্ঘন করেছে; সেক্ষেত্রে তারা সবাই রাষ্ট্রদ্রোহী। এরা অবশ্য ক্ষমতা দখল করেছে সংবিধান লঙ্ঘন করেই। তবুও ক্ষমতা নেয়ার সময় সংবিধান রক্ষার কথা বলেই তাদের শপথ নিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবিধানিকভাবে এখনো বাংলাদেশের জাতির জনক। কত বড় সাহস এদের যে এরা তাঁকে অবমাননার আস্পর্ধা দেখায়! অজ্ঞান, মূর্খ ও লোভী মানুষের ওপর বঙ্গবন্ধুর সম্মান নির্ভর করেনা; এরা এবং এদের পিতা ইউনুস নির্ধারণ করবে বঙ্গবন্ধুর আসন! ওদের আরেক নপুংসুক সুবিধাবাদী গুরু আসিফ নজরুল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে আগে কখনো অসম্মান করেন নাই; কিন্তু ক্ষমতায় এসেই বললেন, পনেরোই আগস্টের শোক তিনি পালন করতে পারবেন না আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ভূমিকার কারণে। কতটা অকৃতজ্ঞ এবং মোনাফেক টাইপের মানুষ হলে এ জাতীয় কথা বলা সম্ভব! আর তাদের পিতা ইউনুসতো রিসেট বাটনের কথা বলে পিছটান দিলো পরে। এরা সবাই মোনাফেক এবং লোভী ও স্বাধীনতাবিরোধী। মনে রাখা দরকার, এই পুরো ঘটনাটির আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আছে এবং এটিতে আন্তর্জাতিক মোড়লদের সমর্থন আছে বলেই ঘটনা দ্রুত স্বাধীনতার সব প্রধান চরিত্র ও সিম্বলকে অপসারণ করছে বা এ ধরনের কাজকে সমর্থন দিচ্ছে। আমরা জানি কেন এমন ঘটছে, এবং কেন এ ঘটনা আরো ঘটবে।
মোটামুটি এরা যা শুরু করেছে তাকে তুঘলকি আমলের অনুরণন ছাড়া কিছুই বলা যায় না। এই শিশুরা এবং তাদের ইউনুস নামের ভন্ড গুরু ইতিহাস পড়েনি বা ভুলে গেছে। এরা অকৃতজ্ঞ এবং প্রচন্ড রকমের ইতিহাস অসচেতন। এরা ভুলে গেছে একাত্তুরে তাদের পাকিস্তানী পিতারা কার বিরুদ্ধে সব রকমের প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলো; কার বিচার করেছিলো তারা দেশোদ্রোহিতার অভিযোগে সারা পৃথিবীর সংবাদপত্রগুলো কাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা মেনেছিলো; তাদের সহকর্মী সারজিস আলম কার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি ভিডিও ক্লিপ বানিয়েছিলো যেটি পরবর্তীতে ভাইরাল হয়েছে কয়েক লক্ষবার। কী বলেছিলো সেখানে সারজিস? নাহিদ নামের গর্দভ এসব কিছুই বোঝেনা। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অনেকে চেষ্টা করে মুজিবের সমান্তরালে ভাবতে। অথচ জিয়া নামের মানুষটি নিজে কখনো এমন দাবী করেননি; বঙ্গবন্ধুকে একবারের জন্যও অসম্মানিত করেননি জিয়া। সংবিধান থেকে অনেক কিছুই তিনি মুছেছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে জাতির জনক সেই স্বীকৃতি তিনি মোছেননি; এরশাদ বা খালেদা জিয়া কেউই এটি করেননি।
জিয়া ১৯৭৪ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন “একটি জাতির জন্ম” শিরোনামে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। তিনি সে লেখার একটি অংশে সাত’ই মার্চের কথা বলেন এভাবে, “তারপর এলো মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহবানে সারা দেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন”। জিয়ার মতই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা স্বীকার করে নিয়েছেন সকল সেক্টর কমান্ডাররা; তৎকালীন প্রবাসী সরকারটি চলেছে তাঁর নামে। নাহিদ আর আসিফের মত কুলাঙ্গাররা তাদের আব্বাহুজুর ইউনুসের মতই ভুলে গেছে, মুজিবের জীবনকাহিনী মানেই বাংলাদেশের ইতিহাস। বাংলাদেশ নামের দেশটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা হয়েছে তাঁর কারণে; তিনিই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এ দেশ স্বাধীন করার কথা বলেছেন; ছয় দফা দিয়ে একটি জাতির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন; এই ছয় দফা এবং পরবর্তীতে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছেন। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, ভূট্টো কারোর কাছে মাথা নোয়াননি। পাকিস্তানের কারাগারে ভূট্টোর প্রস্তাব ফিরিয় দিয়েছেন; ইয়াহিয়ার সমঝোতার প্রস্তাব ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এসব কেবলমাত্র মুজিবের পক্ষেই সম্ভব ছিলো। আজ জাতির পতাকা খামছে ধরা শকুনেরা এসব জানেনা, বোঝেনা এবং এরা অজ্ঞান ও মূর্খ। এরা যে আসলে তাদের ক্যাবিনেট আব্বার রিসেট বাটন তত্ত্বটি ঘুরিয়ে প্রমাণ করতে চায় নিজেদের লুকোনো জামাতী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তা আবোরো বোঝা গেলো।
তবে শেষ কথা এই যে, আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে এমন, “পাগলের সুখ মনে মনে, রাত পোহালে তারা গোনে।” এইটি কেন যেন মনে পড়ে গেলো!