অভিমন্যু ফয়েজী
এই এক লোক যিনি ক’দিন পরপরই একেকটি নম্বর নিয়ে হাজির হন। প্রথমে বললেন, ত্রিশ হাজার কোটি টাকা ফেরত এনেছেন। আজ পর্যন্ত তিনি বলেননি কার টাকা, কোত্থেকে, কোন দেশের কোন ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে তিনি এনেছেন। এরপর বললেন, এদেশের চার-পাঁচটি পরিবার সব টাকা চুরি করেছে। এ পর্যায়েও তিনি বললেন না এই পরিবারগুলো কারা, তাদের কোন্ একাউন্ট বা কোন্ সোর্স থেকে টাকা নিয়ে কোথায় রেখেছে বা কোন্ দেশে রেখেছে। আজ বলছেন, ১৭ বিলিয়ন ডলার নিয়েছেন শেখ হাসিনার কাছের কয়েকটি পরিবার। তিনি একটি পরিবারের নাম বলেছেন; সাথে বলছেন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতরের “কিছু” কর্মকর্তা ব্যাংক দখলে সহায়তা করেছেন। তিনি বলছেন, “প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দপ্তরের সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করতে সহায়তা করেছেন। তিনি জানান, এসব ব্যাংক দখল করে আনুমানিক ২ লাখ কোটি টাকা (১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার) বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নতুন শেয়ারধারীদের ঋণ দেওয়া ও আমদানির অতিরিক্ত খরচ দেখানোর মতো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।” এই কর্মকর্তাগণ কারা? তিনি এঁদের নাম বলছেন না কেন? দ্বিতীয়তঃ যে পদ্ধতির কথা তিনি বললেন সেটিতো অবৈধ পদ্ধতি নয়; যদি পদ্ধতির ভেতর গোলমাল থেকে থাকে তবেতো সেটি তদন্ত কমিটি বের করবে। গভর্ণর কি কোন তদন্ত কমিটি করেছেন যাদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তিনি পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা বলছেন? তিনি তো কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্ততে কোন ত্রুটি দেখাননি। একজন গভর্ণর হিসেবে তিনি কি এমন ফ্ল্যাট বক্তব্য দিতে পারেন? মনসুর যতক্ষণ একাডেমেশিয়ান থাকেন ততক্ষণ ভালো, কিন্তু যখনই তিনি রাজনৈতিক হন তখন আর প্রামাণিক তথ্যের ওপর নির্ভর না করে ফ্ল্যাট কথাবার্তা বলেন। এটি আমি আগেও খেয়াল করেছি।
তিনি আরো বলছেন, “এই মাত্রায় (ব্যাংক ডাকাতি) অন্য কোথাও হয়নি। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট এবং গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িতরা (ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহীদের) মাথায় বন্দুক না ঠেকালে এটা হতে পারত না।” তাহলে তো বোঝা যাচ্ছে আসল কালপ্রিট সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা; তাঁরা কি গভর্ণর মহোদয়ের ভাসুর? শেখ হাসিনার নাম বললেন, এস আলমের নাম বললেন, কিন্তু যাঁরা বন্দুকের নল ঠেকিয়ে এ কাজটি করেছেন তাঁদের নাম বললেন না। ভাবে তো মনে হয়, এঁরা বন্দুক ঠেকানোর সময় মনসুর ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; তা না হলে তিনি জানলেন কিভাবে? কোন বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত কমিটি এটি বলেছে? যদি তাই হয় তবে তো রিপোর্টটি প্রকাশ্যে আসা উচিত; ওই কর্মকর্তাদের নাম বলা উচিত; কিন্তু তিনি তাঁদের নাম বলবেন না! হিপোক্রেসির সীমা থাকা দরকার।
আবার দেখুন, “আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় কয়েকটি ব্যাংক দখল করার পর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা ‘অন্তত’ ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ‘বের করে নিয়েছেন’। তাঁর মতে, ‘তাঁরা প্রতিদিনই নিজেদের জন্য ঋণ অনুমোদন করেছেন।’ এখানেও ডিজিএফআই! কিন্তু এই কর্মকর্তাদের নাম আপনি পাবেন না; কোন রেফারেন্সও পাবেন না; কারণ, এঁরা মনসুর সাহেবের ভাসুর হন সম্পর্কে। হাসিনা খারাপ, আলম খারাপ, ডিজিএফআই খারাপ, কিন্তু মনসুর আর ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারা ভালো! আসলেই ভালো। এঁরা সুপারম্যানের মত সময়কালে নামহীন হয়ে যান।
আপনি মনসুর সাহেবের কথার মধ্যে কোন প্রামাণিক তথ্য পাবেননা। একেবারে বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফের অলিখিত “রাজনীতি” উইংয়ের সলিড কর্মকর্তার মত কথা পাবেন; বেশীর ভাগ কথাবার্তাই ফ্ল্যাট। জানবেন না কোনদিন এস আলম বা অন্যরা কিভাবে, কোথায়, কোত্থেকে, এবং কোন্ চ্যানেলে টাকা পাচার করেছেন, কারণ ওই ডিজিএফআইয়ের মত এনাদের মূল ব্যক্তিরাও মনসুরের ভাসুর সদৃশ ব্যক্তি; এঁদের সরাসরি উন্মুক্ত করবেন না তিনি। আর কেবলতো এস আলম নয়; আর অনেক রথী মহারথী জড়িত; এঁদের কথাও প্রামাণিক তথ্যসহ কখনো জানবেন না; কোন বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত কমিটিও গঠিত হবে না যাদের কথা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। এখানেও মনসুর নাচার।
ফলাফল এই যে, “সাইফুল আলমের পক্ষে আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন এমানুয়েল আরকুহার্ট অ্যান্ড সুলিভান একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে এস আলম গ্রুপ জানিয়েছে, গভর্নরের অভিযোগের ‘কোনো সত্যতা নেই’। এতে বলা হয়, ‘এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশের আরও কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের সমন্বিত প্রচারণা এমনকি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মৌলিক নীতির প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।’” এর জবাব দেয়া মনসুরের পক্ষে সম্ভব নয়, কারন তাঁর বক্তব্যের মধ্যে প্রচুর ঢিল আছে বটে, তাঁর দিকে পাটকেল ছোঁড়ার ক্ষমতাও তাঁর টার্গেট গ্রুপের আছে; আপনি যদি প্রমাণই না দিতে পারেন ডিজিএফআইয়ের নায়কদের নামসহ, তবেতো আপনার অভিযোগ নিতান্তই রাজনৈতিক বক্তব্য বা “প্রপাগান্ডা” বা “প্রচারণা” যাতে এস আলমের ল’ ফার্ম দাবী করেছে। এঁদের বিরুদ্ধে এই ১৭০০ বিলিয়ন ডলার পাচার বিষয়ে মানি লন্ডারিং আইনে যে মামলা হওয়ার কথা সেটি কি হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তবে আপনি কেন পাবলিকলি এসব বলছেন? আপনার উদ্দেশ্য কি পাচার করা টাকা আনার ব্যবস্থা করা, নাকি শেখ হাসিনার ইমেজকে হেয় প্রতিপন্ন করা? সেটি করুন; ক্ষমতা আপনাদের হাতে; পরবর্তী ক্ষমতাবানেরা কী করেন কে জানে? আমরা সাধারণ মানুষ; লীলাখেলা বুঝি কম।
এরপর পাঠক রিপোর্টটি আরো পড়তে থাকুন ধৈর্য থাকলে। সেখানে আপনি থ্রিলার টাইপ “আয়নাবাজী” ধরনের গল্প শুনবেন মনসুরের মুখে। কোন এক হোটেলে নাকি ডিজিএফআইয়ের সদস্যরা ব্যাঙ্ক পরিচালকদের তুলে এনে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে টাকা চুরির ব্যবস্থা করেছে। এত কিছু করা লেগেছে? তাহলে তো বলতেই হবে ঘটনা এত সহজ ছিলোনা। হোটেলগুলো নিশ্চয়ই ফাইভ স্টার টাইপ। হোটেলগুলোর নাম নেই? নাকি এগুলোর মালিকরাও তাঁর ভাসুর সম্পর্কের? হোটেলে না নিয়ে কোন একটা আয়না ঘরে নিলেইতো হয়ে যেতো; ডিজিএফআইয়ের নিজেদেরইতো ভালো আয়না ঘর আছে যেখানে ব্রিগেডিয়ার আজমী ছিলেন, তাঁর “চির নতুন” গামছাও জীবিত ছিলো; সেখানে নিলেইতো এত যন্ত্রণা হতোনা; কী সব বন্দুক ঠেকানো টেকানো! এগুলোর কিছুই লাগতোনা; আয়না ঘরের ছমছমে পরিস্থিতিতে এমনিতেই এঁরা রাজী হয়ে যেতেন। নাহ্ , বাংলাদেশে শেখ হাসিনা স্মার্ট ডিজিএফআই বানাতে পারেননি; মনসুর হলে পারতেন।
মনসুরের কথা শুনে বিষয়টা অনেকটা এমন মনে হচ্ছেঃ আপনি “মাসুদ রানা” সিরিজের থ্রিলার পড়ছেন, লেখক রানারূপী মনসুরকে পাঠাচ্ছেন ভিলেন নিধনে, এবং মনসুর “তবে রে শয়তান” বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন এদের ওপর, কিন্তু তিনি এই ভিলেনদের নাম জানেননা। ওই যে বললাম, মনসুর “মাসুদ রানার” রোলে অভিনয় করতে নেমেছেন, কিন্তু করছেন আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র পঁচা রাজনৈতিক নেতাদের রোল। এখানেই তিনি ধরা খেয়ে গেছেন।
আর বিবরণে না যাই। পাঠক নিচের লিঙ্কে পুরো প্রতিবেদনটি পড়ে নেবেন। আমি যদি কিছু মিস্ করে থাকি আমাকে অনুগ্রহপূর্বক জানাবেন।
মনসুরের জন্য একটা সাজেশন আছে। ধৈর্য ধরুন; আরেকটু মন দিয়ে চিত্রনাট্য তৈরী করুন; “একদেশে ছিলো এক ডিজিএফআই” ধরনের গল্প না বলে তাদের নাম উচ্চারণ করুন আজকালকার আধুনিক ভাদ্রবধুদের মত; তাদের বন্দুক ঠেকানো বিষয়ে আরো বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী বানান, এবং পুরো এপিসোডটি প্রমাণসহ বলুন কিভাবে, কোথায়, কোত্থেকে এইসব ঘটেছে। এস আলম ছাড়াও এ নাটকে আরো যেসব কুশীলব আছেন তাঁদের নামও বলুন; সব ভাসুরের মুখোশ উন্মুক্ত করুন।
https://www.prothomalo.com/business/economics/3lg8p6ywnf