সামগ্রিকভাবে বামপন্থী রাজনীতি হলো এমন একটা রাজনৈতিক ভাবাদর্শ যেখানে সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে যৌক্তিকতার ভিত্তিতে সাম্য ও সমতাবাদ অর্জনকে সমর্থন করা হয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বামপন্থীরা এক অভিশাপের নাম। তাদের নিজেদের এককভাবে কিছু করার সাধ্য নেই কিন্তু তারা বরাবরই নানাবিধ রাজনৈতিক সংকট তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই এরা ছোট বড় নানাবিধ রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। আর এর সুযোগ নিয়েছে অন্যরা। ফলে সার্বিকভাবে দেশের রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। ষাটের দশকে বামপন্থীদের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা তখন থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা করেছে। তৎকালীন বর্ষীয়ান ও ঝানু রাজনীতিবিদ কমিউনিস্ট নেতা মনি সিং ও ন্যাপের মোজাফফর আহমেদ গংরা চল্লিশোর্দ্ধ মুজিবের বিরোধিতা করে গেছেন। শুধু তাই নয়, তাদের উষ্কানিতে সে সময়ে আওয়ামী লীগেরও অনেক নেতা ৬ দফার বিরোধিতা করেছিলেন। এতদসত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিদের অধিকতর স্বায়ত্ব শাসনের আন্দোলনের কর্মপরিকল্পণা হিসেবে ৬ দফা ঘোষণা করেন। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে ১৯৬৯ সালে ছাত্র লীগের ১১ দফা যুক্ত হয়। শুরু হয় ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন সংগ্রাম। ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের সেই নির্বাচনে বামপন্থীরা শ্লোগান দেয়, “ভোটের বাক্সে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর”।
কিন্তু শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যান। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। পরবর্তীতে ‘৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থীরা ভারতের বামদের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার জন্য নানা রকমের পাঁয়তারা শুরু করে। তারা সংগ্রাম দীর্ঘায়িত করে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে সকল শ্রেণিশত্রু খতম করার স্বপ্ন দেখে। তৎকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দৃঢ় সিদ্ধান্তের জন্য তারা ব্যর্থ হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমেদ বুঝতে পেরেছিলেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পাকহানাদার বাহিনী আরো শক্তি বৃদ্ধি করে আক্রমণ জোরদার করবে এবং আরো বেশি সংখ্যক বাঙালিদের রাজাকার ও আলবদর বাহিনীতে যোগদান করিয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের মনোবল দুর্বল করার অপচেষ্টা করবে। এর ফলে ওই সময়ে বামদের কূটকৌশল সফল হয়নি। মাত্র ৯ মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়।
কিন্তু বামেরা থেমে যায়নি। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবরে বামতাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে মোহাম্মদ আবদুল জলিলকে সভাপতি এবং আ. স. ম. আবদুর রবকে যুগ্ম আহবায়ক করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ঘোষণা দিয়ে জাসদ গঠন করা হয়। যা অনেকটা পুরোনো বোতলে নতুন মদের মত।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালে জাসদ মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি রাজাকারদের পরোক্ষ সহযোগিতায় সারাদেশে চরম অস্থিরতার সৃষ্টি করে। তারা তুমুল আন্দোলন শুরু করে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরির চেষ্টা করে। এরপরে জাসদ গণবাহিনী গঠন করে গোটা দেশে আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটাতে থাকে। অপরদিকে পুরোনো ধারার বামেরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার নামে গণতন্ত্রের লড়াই সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়ে বাকশাল গঠন করিয়ে বঙ্গবন্ধুকে এক নতুন বিতর্কের মধ্যে ফেলে দেয়।
তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন দেশের আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা ও বাকশাল গঠন করার অভিযোগ তুলে জনমনে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরিতে এক বছরের মধ্যেই তৎকালীন ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহবুব জামান ও নূহউল আলম লেনিনদের নেতৃত্বে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠে। বামেরা উদীচিসহ বিভিন্ন নামের সংগঠন গড়ে তুলে। তাদের মাধ্যমে আগুনে ঘি ঢালতে থাকে। ওদিকে জাসদের গণবাহিনী বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরেও নানা রকমের বৈষম্যের অজুহাতে সাধারণ সৈন্যসহ নিন্মস্তরের অফিসারদের বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে থাকে। এই দুই ধারার বামদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিরোধী তীব্র আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির সুযোগ নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি শক্তি। তাদের মদদেই ঘটে ১৯৭৫ সালের শোকাবহ ১৫ আগস্ট।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরির মদদদাতা বামেদের কপালে ভালো কিছু জোটেনি। উল্টো এর চরম মূল্য দিতে হয়। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান জাসদের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করে জেলে পুরেন। আর গণবাহিনীর মূল হোতা কর্ণেল আবু তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু দন্ড দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ১১ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি জাসদের সাথে জড়িয়ে পরেন।
১৯৭৫ এর পর থেকে বৈজ্ঞানিক বামেরা প্রথমে জিয়াউর রহমানের এবং পরে এরশাদের দলে ভিড়ে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করে। অনেকেই বিএনপিতে যোগ দেয়। একটা অংশ আবার আওয়ামী লীগে জায়গা করে নেয়। বৈজ্ঞানিক বামতত্ত্বের গুরু সিরাজুল আলম খান আড়ালে চলে যান। এক সময় অনাদর, অবহেলা ও নি:সঙ্গতায় কৃতকর্মের দায়শোধের আত্ম দংশনে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু মুখে পতিত হন। জানা যায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মূল সংগঠক এই তাত্ত্বিক নেতার জানাযায় শ’খানেক লোকও অংশ নেয়নি।
সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির খুনখারাবির কথা এদেশের মানুষ আজও ভুলেনি। ভারতের চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলনের তত্ত্বকে পুঁজি করে মানুষ হত্যার মহোৎসব শুরু করেছিলেন সিরাজ শিকদার।
বর্তমান বাংলাদেশে জাসদ নামের দলটি ভেঙে খান খান। জাসদীয়রা রাজনৈতিক উদ্বাস্তু হয়ে কিছুদিন এখানে তো এরপর অন্যখানে ঢু মেরে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ায়। তবুও তাদের মাথা থেকে কূটচাল দূর হয়না। কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার সময়ে দেখা যায়, বাম নেতা রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু গং শেখ হাসিনাকে জামাত নিষিদ্ধ করার জন্য চাপ দিয়ে আগুনে ঘি ঢালার ব্যবস্থা করে।
এদিকে এরই মধ্যে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ এর আগ পর্যন্ত সময়ের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বাম পন্ডিত ফরহাদ মজহার ২০১৩-২০১৪ সালের জামাত শিবির ও হেফাজতিদের সহিংসতায় ব্যাপক উস্কানি দেন। ফরহাদ মজহার একসময় বিএনপি’র ডান ঘেঁষা রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন । আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর একসাথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কচুকাঁটা করেছেন তাঁর কলামগুলোতে। ফরহাদ মজহার অনেক ঘাটের জল ঘোলা করে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন। তাঁর আজকের এই অবস্থান স্ববিরোধী এবং হঠকারী। বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদের বিস্তাররোধে যে যখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করা উচিৎ তখন ফরহাদ মজহার মাদ্রাসার এতিম ছাত্রদের’ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন মার্কিন আগ্রাসন প্রতিরোধ করার।
সম্প্রতি কোটা আন্দোলনকে এই জাসদীয় জ্ঞানপাপী নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। ষড়যন্ত্ৰ সফল হবার পর তিনি দেশে এসে নতুন এক কলঙ্কের জন্ম দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। তিনি নানা চক্রান্ত করে বিভিন্ন জায়গায় বলে যাচ্ছেন, বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার নয় বরং পুন:লিখন করতে হবে।
এবারও এই বামেরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার সঙ্গী হচ্ছেন। জাতীয় শোক দিবস ও ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ বাতিল করা হলো ; বামেরা তা সম্মতি দিয়ে যাচ্ছে। এবারের রাজনৈতিক সংকট তৈরিতেও বামপন্থীদের কূটচাল দায়ী।
ইয়াসমিন আক্তার
সহ-সভাপতি
সুনামগঞ্জ জেলা শাখা
বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নির্বাহী সম্পাদক, বার্তাধারা
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.