সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাবার পরে বিভিন্ন সরকারি এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা কিংবা পদত্যাগ করার হিড়িক লেগেছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে শেখ হাসিনার মনোনীত কিংবা পছন্দের ব্যক্তিরাই পদে আসীন ছিলেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার এমন প্রেক্ষাপটে পদত্যাগ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল এই কমিশন।
বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে মোট ২৯৯ আসনের মধ্যে ২২৩ আসনেই জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল স্বীকার করেছেন যে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় ২০২৪ সালের নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি।
এখন বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরবর্তী নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিভিন্ন মহলে এক ধরনের আলোচনা চলছে।
বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য হলো, তারা সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য যৌক্তিক সময় দিতে চায়। কিন্তু সেই যৌক্তিক সময়ের মেয়াদ কত, অর্থাৎ কবে নাগাদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার গঠিত হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর জানার কৌতূহল সবার। কিন্তু বিদ্যমান আইনে কোনো নির্বাচন আয়োজন করার প্রধান শর্ত হলো নির্বাচন কমিশন থাকা।
নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হলে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ অনুসরণ করতে হবে সরকারকে।
এই আইন অনুযায়ী, সবার আগে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি তথা সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে।
এই কমিটিতে আপিল বিভাগের একজন বিচারক ছাড়াও আর যারা থাকেবন, তারা হলেন প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত দুইজন বিশিষ্ট নাগরিক। তবে ওই দুই বিশিষ্ট নাগরিকদের মাঝে একজন হবেন নারী।
আইনে বর্ণিত যোগ্যতা-অযোগ্যতা বিবেচনা করে এই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দানের উদ্দেশ্য মোট ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে।
অর্থাৎ, প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুইজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে তারা। ওই ১০ জনের মধ্য থেকেই পাঁচজনকে নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি।
এক্ষেত্রে, কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মাঝে তাদেরকে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পেশ করতে হবে।
কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতা
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে কাউকে সুপারিশের ক্ষেত্রে কয়েকটি যোগ্যতা কথা উল্লেখ আছে আইনে। এগুলো হচ্ছে :-
১. তাদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।
২. তাদের বয়স হতে হবে ন্যূনতম ৫০ বছর।
৩. কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
সিইসি ও কমিশনার পদে অযোগ্যতা নিয়ে ছয়টি বিষয় উল্লেখ আছে। সেগুলো হচ্ছে :-
১. আদালত অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে
২. দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে
৩. কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে।
৪. নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ বা ‘বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার, ১৯৭২’-এর অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ছাড়া প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে।
বর্তমান আইন মানতে হবে?
২০২২ সালের আগে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আলাদা কোনো আইন ছিল না। ওই বছর নতুন কমিশন গঠনের আগে ওই আইন প্রণয়ন করা হয়। আর সেই আইনের অধীনে প্রথম নির্বাচন কমিশনার হন কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ পাঁচজন।
এখন যেহেতু বিদায়ী সরকারের আমলে প্রণীত নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ক সংসদে পাশ হওয়া আইন বলবৎ আছে, তাই সরকারকে সেই আইন অনুসরণ করে নতুন কমিশন করতে হবে। কিন্তু ওই আইনকে পাশ কাটিয়ে অন্য কোনো উপায়ে কমিশন গঠন করার সুযোগ আছে কি-না?
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, ‘সরকার যদি মনে করে যে সেই আইনটা যৌক্তিক না, সেক্ষেত্রে ওই আইনকে বাতিল করে সরকার তার মতো করে পদক্ষেপ নিতে পারে।
শহীদ খান আরো বলছিলেন, ‘আইনটাকে যৌক্তিক না মনে হলে সেটি বাতিল করে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার।’
নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলীম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য বাংলাদেশে বর্তমানে যে আইন রয়েছে সেটি ত্রুটিপূর্ণ।’
আলীম উল্লেখ করেন, ‘এই আইন বাতিল করে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে নতুন আইনের মাধ্যমে কমিশন গঠন করা যায়।’
আলীম বলছিলেন, ‘হয়তো এই আইনটিকে বাতিল করতে হবে, নয়তো ব্যাপকভাবে সংশোধন করতে হবে।’
তিনি মনে করেন, বিদ্যমান আইনটিকে বাতিল করে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমেও নির্বাচন কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
আইনে সমস্যা কোথায়?
নির্বাচন কমিশনার গঠন বিষয়ক আইন নিয়ে শুরু থেকেই অনেক সমালোচনা ছিল। সমালোচনার পেছনে কিছু কারণকে চিহ্নিত করেন সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত, যে পার্লামেন্টে এই আইনটা পাশ হয়েছিল, ওই পার্লামেন্টের ব্যাপারেই রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি ছিল। ওই পার্লামেন্টকেই তারা স্বীকার করতেন না।’
তিনি আরো বলেন, ‘ওই সময় এই আইনটি অনেকটা তড়িঘড়ি করে পাশ করা হয়েছে সংসদে। তাই সরকার যদি মনে করে, তবে এই আইনে পরিবর্তন আসতেও পারে।’
আইনের ত্রুটিগুলো কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইনের ত্রুটি চিহ্নিত না করে তারা একটি বেইসিক পয়েন্টে বারবার কথা বলছিল-পার্লামেন্ট অবৈধ, তাই এভাবে করা যাবে না।’
তাছাড়া, বিদ্যমান আইনে যেভাবে সার্চ কমিটি গঠন করার বিধান রাখা হয়েছে সেটি নিয়েও অনেকের আপত্তি ছিল।
‘ওই আইনে আগের নির্বাচন কমিশনকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল, এটিও আপত্তির আরেকটা কারণ।’
সদ্য ভেঙ্গে যাওয়া নির্বাচন কমিশন সমন্ধে এই সাবেক সচিবের বক্তব্য হলো যে বিদায়ী সরকারের আমলে সামগ্রিকভাবে দেখানো হয়েছে, যা হচ্ছে তা সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে হচ্ছে। কিন্তু এগুলো ‘উপরের অংশ। সার্চ কমিটি নিয়ে অনেকেরই অনেকরকম বক্তব্য আছে। অনেকেই বলে যে এখানে পলিটিক্যাল কন্সিডারেশন ছিল। তাছাড়া, এখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা ছিল।’
কিভাবে গঠন হতে পারে?
নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বলেন, ‘নির্বাচন গঠনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু গাইডলাইন আছে।’ বিভিন্ন দেশে এসব গাইডলাইন কিংবা রীতি অনুসরণ করা হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তার মতে, সার্চ কমিটিতে যারা থাকবেন তারা হবেন নিরপেক্ষ। সার্চ কমিটি নিরপেক্ষ না হলে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা যাবে না।
আব্দুল আলীম মনে করেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে যেভাবে সার্চ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে সেটি নিরপেক্ষ নয়। কারণ, সরকারি বিভিন্ন পদে যারা থাকেন তারা মূলত ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা নিয়োগ করা। সেক্ষেত্রে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন না বলেও মনে করেন তিনি।
যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে সেটি হতে হবে স্বচ্ছ। অর্থাৎ সার্চ কমিটি প্রাথমিকভাবে কাদের নাম প্রস্তাব করেছে এবং শেষ পর্যন্ত কাদের নিয়োগ করা হয়েছে সেটি জনগণের জানা উচিত।
আলীম বলেন, প্রাথমিক তালিকা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে জনগণ জানতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী, সার্চ কমিটি যেসব নাম প্রস্তাব করে সেগুলো সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা থাকে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
নির্বাচন নিয়ে কাজ করার যাদের অভিজ্ঞতা, গবেষণা এবং পড়াশুনা আছে তাদের নির্বাচনে কমিশনে নিয়োগ করা উচিত বলে উল্লেখ করেন আলীম। এখানে নেতৃত্ব দেবার গুণাবলী একটি বড় বিষয়। বিষয় করে যিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হবেন তার নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা থাকতে হবে।
যাদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হবে তাদের বিষয়ে ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান করা দরকার। তাদের অতীত কেমন, পেশাগত জীবন কেমন ছিল ইত্যাদি বিষয়।
কোনো সঙ্কট আছে?
আবু আলম শহীদ খান মনে করেন, নির্বাচন কমিশনাররা পদত্যাগ করায় কোনো সঙ্কট হবে না। এর প্রধান কারণ, এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের হাতে বড় কোনো কাজ নেই।
খান বলেন, ‘যদি একটা নির্বাচন ডিক্লেয়ার করা থাকতো বা নির্বাচন চলাকালীন যদি ঘটনাটা ঘটতো, তাহলে সঙ্কট তৈরি হতো। তাই, আপাতত এখানে কোনো সঙ্কট নেই।
তিনি জানান, সরকার যদি আইন অনুসারে যেতে চায়, তাহলে নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য সরকারের হাতে ‘যথেষ্ট সময়’ আছে।
তিনি মনে করেন, এই সময়টা বিদ্যমান আইন বাতিল করে অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে নতুন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার জন্যও যথেষ্ট।
এখানে উল্লেখ্য, গত আড়াই বছরে দেড় হাজারের বেশি বিভিন্ন নির্বাচন করেছে এই বিদায়ী কমিশন।
এমন পদত্যাগ কী এবারই প্রথম?
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পুরো কমিশনের বিদায় নেয়ার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবার পরে বিদায় নিতে হয়েছিল তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজ ও অন্যান্য কমিশনারদের।
সেই কমিশন বিএনপি সরকারের আমলে গঠন করা হয়েছিল এবং তারা একতরফা নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
সূত্র : বিবিসি