অভিমন্যু ফয়েজী
একে একে অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে যাচ্ছে, নাকি বিপক্ষে যাচ্ছে সেসব বিশ্লেষণ করার মত মানুষ মনে হচ্ছে সরকারের মধ্যে নেই। ক’দিন আগে খবর পাওয়া গেলো, বর্তমান সময়ের সাহসী কন্ঠ জনাব জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে হত্যা প্রচেষ্টার একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। এই মামলা রুজু হওয়ার কারণটি আমার মত অনেক কম বুদ্ধির মানুষের রাডারেও ধরা পড়েছে, আর যাঁদের বুদ্ধি বেশী তাঁরাতো ঘটনাটি ঘটার আগেই এটির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আজই আবার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোন্ দিকে যাচ্ছে দেশ? কী ধরনের সংস্কার করছেন বর্তমান সরকার? একটু কি তলিয়ে দেখা যায়?
সরকার সংস্কার করার জন্য অনেকগুলো কমিশন করেছেন। এই কমিশনগুলোর মতামত পাওয়া গেলে তাঁদের সংস্কারের কাজগুলো এগিয়ে যাবে— এমনটাই আমাদের ধারনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি বেশ কিছু কর্মকাণ্ড বর্তমান সরকার সম্পর্কে আমাদের সন্দিহান করে তুলছে। কমিশনগুলোর সুপারিশ আসার আগেই সরকারের কাজকর্ম পূর্ববর্তী “ফ্যাসিস্ট” সরকারের জায়গায় নতুন ধরনের ফ্যাসিজম কায়েম করার ইঙ্গিত দিচ্ছে কিনা তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। বরং বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কাজগুলো আরো বেশী ফ্যাসিজমের বহি:প্রকাশ বলে মনে হচ্ছে।
পূর্ববর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে আড়াই মাসের বেশি হলো। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমি এমন কোন তাৎপর্যপূর্ণ। কার্যক্রম দেখছিনা যার ভিত্তিতে এ সরকারকে আগের সরকারের তুলনায় একটি বড় চেক দেয়া যায় যেটিতে তাঁরা উল্লেখযোগ্যভাবে আগের সরকারের চেয়ে এগিয়ে আছেন।
বরং বর্তমান “মেধাবী” বলয়ের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং বক্তৃতার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, তোঘলোক বেচারা বেঁচে থাকলে লজ্জা পেতেন। উনাদের কাজ আর কথা এই দুই জিনিস মিলেনা। নাহিদ যদি বলেন, আমারে দেখো, সাথে সাথে আসিফ মাহমুদ বলে, আরে ও কে? আমার দিকে তাকও। এই চাওয়া চাওয়ি চলছে নিরন্তর।
পান্না সাহেবের বিরুদ্ধে কেস্ দিয়ে হজম করা গেলেও ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করে এর পরবর্তী ধাক্কা সামলানো যাবে তো? এসব কর্মকাণ্ড জরুরী বেশী নাকি মানুষের জীবন যাপনের যে মান সেটির বিষয়ে কাজ করা প্রয়োজন ছিলো বেশী? ছাত্রলীগ প্রসঙ্গে পরে আসি। পান্না সাহেবকে বিপদে ফেলার চেষ্টাটা করার আগে আরেকটু ব্রেইন খাটানো দরকার ছিলো। তাঁর অপরাধ কী? এই সরকার তাঁর বিষয়ে কোনদিন কোন অভিযোগ করেছে বলে শুনি নাই। আমার ধারনা পান্না সাহেবের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ এই যে, এই মানুষটি মুক্তিযোদ্ধা; খুবই একগুঁয়ে স্বভাবের মুক্তিযোদ্ধা। আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন তিনি, কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী ঘরানার সরকারের সকলকে তিনি বারবারই সাবধান করেছেন আমাদের স্বাধীনতার বিষয়ে, এবং তাঁদের নিষেধ করেছেন বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতার ইতিহাস, আমাদের সংবিধানে হাত না দিতে। “রিসেট বাটন পুশ” তত্ত্বের শক্ত বিরোধিতা করেছেন তিনি একেবারে প্রথমেই। এগুলোই তাঁর পাপ। কারো কাছে কখনো কিছু চাননি এবং পানওনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। তাঁকে আওয়ামী লীগ সম্মান করেনি; তিনিও সম্মানের জন্য যাননি। এখন যখন বড় বড় আওয়ামী লীগাররা হয় বিপদে আছেন, নয় রাজনৈতিক প্লাস্টিক সার্জারী করে চেহারা পাল্টে ফেলেছেন, তখন পান্না দেখিয়ে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা কাকে বলে। তঁকে দাবানো যাবে কি? পান্না সাহেব কিন্তু আওয়ামী লীগের নন্; বরং তিনি এই মেধাবী বৈষম্যবিরোধী” আন্দোলনের একজন শক্ত সমর্থক ছিলেন।
আমি খবর পাচ্ছি, শুধু কোন এক সময় আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের মিছিলে যাওয়ার কারণে মানুষজনের দোকানপাট ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। এই যে কাজগুলো হচ্ছে সেগুলো কি এই সরকার সম্পর্কে মানুষকে ভালো ধারনা দিচ্ছে? হয়তবা দিচ্ছে; কে জানে?
এবার ছাত্রলীগের কথা বলি। আওয়ামী লীগের এই ছাত্রফ্রন্টটি বিগত সরকারের সময় প্রচুর জনবিরোধী কাজকর্ম করেছে তাতে সন্দেহ নেই। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রফ্রন্টগুলো সব সময়ই তাদের দাপট দেখিয়েছে সব আমলেই। আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি’র পার্থক্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মেয়াদ ছিলো অনেক বেশী; “স্বাভাবিকভাবেই” তাদের দাপটের প্রকাশও ছিলো বেশী; কিন্তু সদ্য বিগত আন্দোলনের প্রথম কয়েকদিন ছাত্রলীগের ভূমিকা থাকলেও এটির মূল বাস্তবায়নের সময় ছাত্রলীগ মাঠে ছিলোনা। এখনতো একেবারেই নেই তারা। তাদের সব অপকর্মের বিচার হতে পারে, কিন্তু এভাবে তাদের নিষিদ্ধ করার পেছনে শুধু ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার ব্যপার নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করার অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ পদক্ষেপও বটে। কিন্তু কেন ছাত্রলীগ? কারণ, এটির ইতিহাসের সাথে স্বাধীনতার ইতিহাস জড়িত; এটির ইতিহাসের সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম জড়িত; ছাত্রলীগের ইতিহাস আর বাংলাদেশের ইতিহাস একাকার।
বোঝাই যাচ্ছে, এই স্বাধীনতাবিরোধী ক্ষমতাসীন শক্তির পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। উপদেষ্টা নাহিদ বলেই দিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে দেবেননা। এর আগে জনাব আসিফ মাহমুদও বলেছেন এ জাতীয় কথা। এ এক অদ্ভূত দেশ! স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী কথা বলে ক্ষমতা নিয়েছেল এঁরা, কিন্তু নিজেরা যে আরো বড় ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠছেন তা বুঝছেননা। এরা আইন, কানুন, নিয়ম, নীতি কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছেননা। একটি দল এখনো আইনগতভাবে বৈধ; অথচ সরকারের দুইজন বলছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগকে ফিরতে দেবেননা! “অল্পবয়স্ক উপদেষ্টাদের ব্রেইনও শিশুদের মতই। আমার ধারনা, এই “শিশু“রা ছোট বেলায় খেলার মাঠে কারো কাছে পরাজয়ের আশঙ্কা থাকলেই তাকে আর মাঠে ঢুকতে দিতেননা, এবং এইটি এই তাঁদের চরিত্র ও মগজের ব্রেইনে স্থায়ী হয়ে গেছে। হারুনের হোটেলে কাচ্চি খেয়ে আরামদায়ক লুঙ্গি পরিহিত এক “অল্পবয়স্ক ” নেতা কিন্তু আন্দোলন স্থগিত ঘোষনা করেছিলেন; ইনি “অল্পবয়স্ক” বলেই জানেন মাইরের উপরে ওষধ নাই; উউপদেষ্টা হলেও এই লোক জানেন, একবার আআওয়ামী লীগ সুযোগ পেলে “অল্পবয়স্ক” বলে তাঁকে মাফ করবেনা যেটি আগে করেছে; কাজেই আগেই নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা দরকার আর কী। আর সেই সাথে তাঁর রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গুরুদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে হবে তো— তাই এত কিছু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে কিছু ছিলোনা; থাকলেও এটির নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু ছিলেননা— এইটি প্রমাণ করাই তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখন। ভেবে দেখুন, তাঁদের মিত্র আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে চারের ঘরে আর মূল্যস্ফীতি বাড়বে- এ জাতীয় বিষয় নিয়ে এঁদের কোন কথাবার্তা বা কাজকর্ম নেই। তাঁরা চেষ্টা করছেন বিএনপিকে একটু “গুড হিউমারে” রেখে আওয়ামী সব কিছু ধ্বংস করতে। এটাই যেন এঁদের কাজ। তোঘলকি স্টাইলে দেশ চালাচ্ছেন উনারা। পানের থেকে চুন খসলেই মামলা দিচ্ছেন সমাজের সম্মানিত মানুষদের বিপক্ষে; চুরি চামারি যাঁরা করছেন তাঁদের জন্য সব কিছু খোলা রেখেছেন; নৌকার সিন্ডিকেট থেকে ধানের শীষের মোকামে পরিবর্তিত স্থাপনাগুলোকে নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। আন্দোলন চলাকালে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা খুনখারাবি করেছে, সংখ্যালঘুদের বাড়ীঘর দোকানপাট ভেঙ্গেছে, তাদের মন্দির ভেঙ্গেছে, গর্ভবতী সদস্যসহ তিনহাজারের ওপর পুলিশ হত্যা করেছে এদের সবাইকে ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছে। অসভ্য রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার এরচেয়ে ভালো উদাহরণ আর হতে পারে না। কী একটা অবস্থা এই দেশের!
এই অল্প বয়স্ক উপদেষ্টাদের বলি, ইতিহাস পড়ুন। সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ও প্রকরণ জানুন। আওয়ামী লীগও ভাবে নাই তারা ক্ষমতাচ্যুত হবে। বিএনপিও ২০০১-২০০৬ এ এমন জিনিস তাদের ব্রেইনে নেয় নাই। কিন্তু ইতিহাস বলে, সবই সম্ভব। পাঠক খেয়াল করলেই বুঝবেন, বঙ্গবন্ধু, আমাদের স্বাধীনতা ইত্যাকার বিষয়গুলো নিয়ে মূলতঃ কথা বলছেন আমাদের দুই “অল্পবয়স্ক ” উপদেষ্টা। এঁদের দিয়েই বলানো হচ্ছে সকল অশুভ বাতচিত। আমার খালি মনে হচ্ছে, এঁরাও এই ক্ষমতা পেয়ে খুব আনন্দিত; মুখে যা আসছে তাই বলছেন। এঁরা যেন ছোট বেলায় রাজা-উজির খেলার শিশু খেলোয়াড় মাত্র; অন্যভাবে বললে বলা যায়, এঁরা দাবা খেলার সৈনিক মাত্র; রাজা অনেক দূর থেকে এঁদের চালাচ্ছেন; আর মূল খেলোয়াড়টি মজা দেখে চলেছেন, কারণ তাঁর মগজে ব্রেইন আছে।
“ইতিহাস চলে যায়না; ইতিহাসে বারবারই দেখা হয় কুশীলবদের”।