২০১০-২০১১ সালের দিকে আমি আমার মাস্টার্সের একটা কোর্সের ফিল্ড ওয়ার্ক করেছিলাম গ্রামীন ব্যাংকের একটি শাখা অফিসে।তখনকার অভিজ্ঞতা ও গ্রামীণ ব্যাংকে কাজ করা কর্মকর্তাদের থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতার আলোকে সত্য ঘটনা অবলম্বনে উত্তম পুরুষে লিখেছি। লেখাটা শেয়ার করার অনুরোধ রইলো।
আমি ছদ্মনাম কবির আহমেদ ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানে তিনটি উপজেলায় ঋণ কার্যক্রমে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছি এবং যার মধ্যে একটি উপজেলার প্রায় ৫,০০০ জন নারীকে ঋণের জন্য সদস্য হিসেবে ভর্তি করি যার মধ্য থেকে এক বছরে প্রায় ৪,২০০ জন নারীকে ক্ষদ্রঋণ প্রদান করি। এর মধ্যে প্রায় সকল সদস্যই ২য়, ৩য় বা ৪র্থবারের মতো ঋণ নিয়েছেন। ঋণগ্রহীতা এই বিপুল সংখ্যক সদস্য আমার হাত দিয়েই ঋণ নিয়েছেন এবং প্রায় সকল গ্রাম সমিতিতে আমার যাওয়া হয়েছে এবং প্রায় সকলেই আমাকে চিনেন। সমিতিতে গেলে চেয়ার বা টুলে বসতে দিতেন। আমার গরীব এই নারীদের, তাঁদের স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের সাথে নিবিড়ভাবে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। দরিদ্র্য এই সদস্যরা তিন থেকে চার বছর যাবৎ সংস্থার সদস্য হয়ে প্রতি বছর ঋণ নিয়েছেন। প্রায় সকল সদস্যই ঋণের টাকা নিয়েছেন তাদের সংসারের আয় উন্নতির জন্য কিন্তু এত দিন ঋণ নেওয়ার পরও তাদের অর্থনৈতিক কোন উন্নতি দেখতাম না। তারা ঋণের কিস্তি দিতে পারতো না। ১ম ও ২য়বার নেওয়া ঋণ কোনমতে পরিশোধ করতে পারতো কিন্তু ৩য় বা ৪র্থবার ঋণ নিলে আর পরিশোধ করতে পারতো না এবং প্রায় সবাই খেলাপী সদস্য হিসেবে পরিগণিত হতো। আবার অন্য এনজিও থেকেও ঋণ নিত। আমি পুরো উপজেলার ৯/১০টি ইউনিয়নের সকল গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে বেড়াতাম আর ভাবতাম গরীব এই সদস্যরা ঋণ নিচ্ছে কিন্তু তাদের সংসার ও জীবনমানের কোন উন্নয়ন তো দেখছি না! উক্ত উপজেলার চারদিকে পানিবেষ্টিত ও বিল পাঁড়ের একটি সমিতিতে যাই। সেটি দেখে যখন ফিরব তখন মাঠকর্মী বলল ভাই বিলের একেবারে শেষ মাথায় একটি বাড়িতে একজন মহিলা আছে যে ১২,০০০/= (বার হাজার) টাকা ঋণ নিয়ে এসেছিল কিন্ত প্রায় দশ মাস হলো সে একটি কিস্তিও পরিশোধ করেনি এবং আমার কোনো কথাই তিনি ও তার স্বামী শুনেন না। তারপর কাঁচা রাস্তায় বিলের পাঁড় দিয়ে অনেকদূর হেঁটে তার বাড়ি যাই। সদস্য মহিলাটি আমাকে দেখেই ঘর থেকে চেয়ার নিয়ে আমাদের বসতে দিলেন। আমার কর্মী তার ঋণের কিস্তির পাশ বইটি আমাকে দেখিয়ে বললেন সে ৩য়বার ঋণ নেওয়া পর কোনো কিস্তি দেয়নি। আমি সদস্য মহিলাকে বললাম ঋণের বিষয়ে কি করবেন? তিনি বললেন স্যার, এই ঋণ নিয়ে আমি ৭৫টি হাঁস কিনেছি। এর সাথে তার আরও ৪০/৫০টি হাঁস ছিল এখন প্রতিদিন প্রায় ১০০টি করে ডিম পাওয়া যায় এবং এই বর্ষায় ডিম বেচার টাকায় আরও ২০০টি ছোট সাইজের বাচ্চা কিনেছি এবং এখন প্রায় ৩০০টি হাঁস রয়েছে তাদের। তার স্বামী আগে অন্যের বাড়িতে দিনমজুরি করতো এখন নিজের হাঁস দেখাশুনা করেন। আজ তার স্বামী বিলে হাঁস নিয়ে গেছেন। সন্ধ্যার আগে হাঁস নিয়ে ফিরে আসবেন। মহিলাটি বললেন কোন ম্যানেজার এই প্রথম আমার বাড়িতে আসলো। স্যার আজ চলে যান। আমি খুব শীঘ্রই অফিসে গিয়ে সমুদয় টাকা দিয়ে আসব। মাঠকর্মী বললো, ভাই এই কথা তিনি প্রতিদিন বলেন কিন্তু কোন কিস্তির টাকা দেননা। আজ একটি কিস্তির টাকা হলেও নিয়ে যাব। আমি কর্মীকে বললাম দেখি না তিনি ভবিষ্যতে টাকা দেন কিনা? ফিরে আসার সময় মহিলাটি আমাকে ঘরে ডেকে নিয়ে ৩০টি ডিম একটি পুরোনো লুঙ্গিতে ধানের কুঁড়া দিয়ে বেঁধে আমার কর্মীকে নিতে বললেন। আর বললেন এই ঋণ নিয়ে আমি উপকৃত হয়েছি। আমার স্বামী আগে দিনমজুর ছিল এখন আর দিনমজুরী করেন না। প্রতিদিন আমার ২০০/২৫০ টাকা আয় হয় (তখন ডিমের হালি ছিল ৭-৮ টাকা)। আমি জানি আপনারা কোনো কিছু সদস্যদের বাড়িতে খান না। তবুও আপনাদের অফিসে অনেক লোক আছে। সবাই একটি করে ডিম খেয়ে আমার ও আমার ছয় মাসের ছেলের জন্য দোয়া করবেন। আমি মহিলার কথায় আশ্বস্থ হয়ে অফিসে ফিরে আসি এবং বিকালে সেই ডিম সিদ্ধ করে আমরা সবাই একটি করে খাই। এর প্রায় ২/৩ মাস পর একদিন সেই মহিলা তার স্বামী ও ছোট শিশুপুত্রকে নিয়ে অফিসে আসেন এবং সমুদয় বকেয়া টাকা পরিশোধ করে দিয়ে যান।
এই ঘটনাটি আমাকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলে। প্রায় ৪২,০০ ঋণগ্রহীতা সদস্যদের মধ্যে যারা মোটামুটি নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেছেন তাদের জীবনের কোন উন্নতি দেখা যায়নি। ৫০% থেকে ৮০% কিস্তি পরিশোধ করেও সদস্যরা দারিদ্র্যের সেই করুণ অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। কিন্তু যে সদস্য ৩য়বার ঋণের নিয়মিত কোন কিস্তি না দিয়ে হাঁসপালন করে তার সংসারের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। তাহলে আমি দেখতে পেলাম, যে ঋণখেলাপী এবং ঋণের কিস্তি দেয়নি তার উন্নয়ন ঘটেছে! আর যারা ঋণের কিস্তি নিয়মিত দিয়েছে তারা আরও গরীব হয়েছে!
তারপর আমি ঐ উপজেলা থেকে অন্য এক উপজেলায় বদলি হই। সেখানেও দেখতে পাই বেশিরভাগ সদস্য ১ম ও ২য়বার ঋণের কিস্তি মোটামুটি পরিশোধ করেন। কিন্তু ৩য়বার ঋণ নিয়েই তারা খেলাপী হয়ে যান। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে ঋণ নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেন না। তখন আমি এই ক্ষুদ্র ঋণের সুদহার, বিতরণ ব্যবস্থা, সঞ্চয় নেওয়া ও কিস্তি পরিশাধের সময় ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক হিসাব নিকাশ করতে থাকলাম। কেন নারীরা ঋণ নিয়ে উন্নতি করতে পারেছ না অথবা আরও গরীব হয়ে যাচ্ছে!
সদস্য ভর্তি ও ঋণ দেওয়া পদ্ধতিঃ
তখন (১৯৯০ দশকের শেষ দিকে) সাধারণত গড়ে ৩০ জন নারী সদস্য (কম/বেশী হতে পারে) নিয়ে একটি নারী সমিতি দল গঠন করা হতো। আবার এর মধ্যে ৫ জনের ছোট দল ছিল যারা একই বাড়িতে বা কাছাকাছি ছিল। ২০ টাকা সদস্য ফি দিয়ে পাশ বই কিনে সমিতির সদস্য হতে হতো এবং ৪-৬ সপ্তাহ ১০/২০ টাকা করে সঞ্চয় জমা দেওয়া ও সমিতির সভায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করলে তাকে ঋণ দেওয়া হতো। ভর্তি ফি বাদে ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা সঞ্চয় জমা হলে সে সদস্য কে ২০০০ বা ৩০০০ টাকা ঋণ দেওয়া হতো। সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হতো সাপ্তাহভিত্তিক ৪৬টি কিস্তির মাধ্যমে অর্থাৎ ৪৬ সপ্তাহে এবং কিস্তির টাকার পরিমাণ একই ।
সুদের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনঃ
ক্ষুদ্র ঋণের একজন সদস্য ১৫% সুদে ২,০০০ টাকা ঋণ নিতে হলে কমপক্ষে ২০০ টাকা সঞ্চয়ের টাকা জমা দিতে হয় এবং ৪৬ সপ্তাহে (যাকে বলা হয় Flat Rate) সুদাসলে মোট ২৩০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ প্রতি কিস্তির পরিমাণ ৫০ টাকা এবং ঋণ বিতরণের সময় বাধ্যতামূলক ৫% সঞ্চয় (৫০ টাকা) ঋণের টাকা থেকে কেটে রেখে সদস্যের সঞ্চয় হিসাবে দেখিয়ে দেওয়া হয় অর্থাৎ একজন সদস্য ঋণের ১৯৫০ টাকা হাতে পায় (২০০০– ৫০ টাকা) । এই ১৯৫০ টাকা ঋণ পেতে তাকে ২০০ টাকা সঞ্চয়ের টাকা জমা দিতে হয় এবং এই সঞ্চয়ের টাকা ঋণের ডাউন পেমেন্ট হিসেবে দেখলে প্রকৃত পক্ষে সে টাকা হাতে পেয়েছে ১৭৫০ টাকা (১৯৫০-২০০); সে হিসেবে ১৭৫০ টাকায় সুদ আসলে পরিশোধ করতে হয় ২৩০০ টাকা ( এক হাজার টাকায় সুদ ১৫০ টাকা)।
আবার, প্রতি সপ্তাহে ৫০ টাকা করে ঋণের কিস্তি এবং ১০ টাকা করে সঞ্চয়ের টাকা জমা দতে হয় ঐ ১৭৫০ টাকা থেকে এবং একজন সদস্য ঋণের পুরো টাকা এক বছরের জন্য ব্যবহার করতে পারে না। প্রতি সপ্তাহেই তার মূল মূলধন থেকে কিস্তি ও সঞ্চয় বাবদ ৬০ টাকা করে দিতে হয় এবং আসল টাকা কমে যায় এবং তারা এই কিস্তির টাকা পরিশোধের জন্যই অতি ব্যস্ত থাকেন। অর্থাৎ একজন সদস্য ১৭৫০ টাকার কিস্তি পরিশোধের জন্য প্রকৃতপক্ষে ১৭৫০/২= ৮৭৫ টাকা মূলধন হিসেবে ৪৬ সপ্তাহ ব্যবহার করার সুযোগ পান। যেহেতু ৮৭৫ টাকায় সুদে আসলে পরিশোধ করেন ২৩০০ টাকা অতএব সুদহার হলো ২৬২.৮ % যা এক বছরের হিসাব ধরে। কিন্তু বেশিরভাগ সদস্যরা পরবর্তী ঋণ নেয়ার জন্য ৪৬ সপ্তাহের আগেই ৪০ সপ্তাহের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করেন তাই ঋণ ব্যবহারের সময় হিসেবে সুদের হার পরিবর্তন হবে এবং সুদ হার দাঁড়ায় প্রায় ৩২৪ % (ঐকিক নিয়মে সুদকষা অংক)। কিস্তির সাথে সঞ্চয় জমা দেওয়া হিসাব ধরলে এই সুদহার আরও অনেক বেশি হবে। কারণ প্রতি কিস্তির সাথে সঞ্চয় হিসেবে যে ১০ টাকা সদস্য প্রদান করেন তা তার মূলধন থেকেই দেয়। সে হিসেবে অন্তত ৪০ সপ্তাহে ৪০০ টাকা প্রদান করেন এবং এর Mid Value হিসেবে ২০০ টাকা তার মূলধন কমে যাচ্ছে (৮৭৫-২০০=৬৭৫ টাকা) এই ৬৭৫ টাকায় সুদাসলে পরিশোধ করেন ২৩০০ টাকা!! ৩৬৪% এর উপরে সুদ!! (যদিও সদস্যদের জমা করা সাপ্তাহিক সঞ্চয়ের টাকার ওপর Mid Value ধরে বাৎসরিক ব্যাংক হারে (৬%) সুদ দেওয়া হয়, যা পর্বতের মুষিক প্রসবের শামিল। আমি এই সুদহারেও সন্তুষ্ট নই। মূলধনের ব্যবহার মাসুলসহ অন্যান্য বিষয় ধরলে এই সুদ হার কোথায় গিয়ে ঠেকে জানি না। বড় গবেষক না হলে এর প্রকৃত সুদহার বের করা ভীষণ কঠিন।
আবার, এই সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে যে ঋণ ও সঞ্চয়ের কিস্তি দিচ্ছে সেই অর্থ প্রতি দিনই অন্য সদস্যদের ঋণ প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সংস্থার টাকা এক দিনও ব্যাংকে পরে থাকে না। প্রতিনিয়ত ব্যবহার করা হয়। ক্ষুদ্র ঋণের সংস্থাগুলো সাধারণ গরীব সদস্যদের মূলধন ব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে। এর জন্যই আমি দেখি শাখা শুরুর জন্য মাত্র ১০-২০ লক্ষ টাকা ব্যবহার করে (Seed Money) দুই বছরের মধ্যেই একটি শাখার মুলধন স্থিতি (ঋণ ও সঞ্চয়ের টাকা) কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় এবং সেখান থেকে প্রতি মাসে অফিস ভাড়া ও ১০-১৫ জন কর্মীর বেতন দেওয়ার পরও। একটি শাখা ভেঙে দুটি শাখাও হয়েছে মাতে দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে এবং মোট মুলধন স্থিতি তিন কোটি টাকার কাছাকাছি হয়েছে। যেখানে সংস্থাকে আর কোনো বাড়তি মূলধনের যোগান দিতে হয়নি। সব টাকাই গরীব মহিলাদের সঞ্চয় ও কিস্তির টাকা। অনেকটা সবজি বা মাছ বিক্রেতার মতো- প্রতিদিন যে টাকায় মাছ বা সবজি কিনে দিন শেষে যা লাভ হয় পর দিন সমুদয় টাকায় আবার মাছ বা সব্জি কিনে বিক্রি করে। পুঁজি প্রতিদিন রিভলভিং করে লাভ হয় প্রতিদিন !
ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী হিসেবে নোবেল প্রাইজ পাওয়া গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্য সকল সংস্থা প্রায় একই পলিসিতে ঋণ প্রদান করে এবং সুদহার প্রায় একই। তবে ২০০৮ সালের দিকে Mrcro Credit Regulatory Authority (MRA) হওয়ার পর থেকে সরকার সুদহার ২৪%-২৫% নির্ধারণ করেছে এবং ঋণ বিতরণের সময় সদস্যদের বাধ্যতামূলক সঞ্চয় ৫% কর্তন বন্ধ করেছে। তবে কিস্তির পরিমাণ ৪৬ সপ্তাহই রেখেছে। সকল মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থাকে সরকারি প্রতিষ্ঠান পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিএসএফ) ফান্ড দিয়ে থাকেন। পিকেএসএফ গঠন হয় ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর তিনশত কোটি টাকার ফান্ড দিয়ে যা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে যার ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের মত সুযোগ সুবিধা পায়।
প্রচলিত ব্যাংক থেকে একজন মানুষ ঋণ নিলে পুরো টাকা ঋণের মেয়াদ শেষ করে সুদে আসলে ফেরৎ দেন এবং কোনটা কিস্তিতে পরিশাধযোগ্য হলে কিস্তিতে পরিশোধ করে এবং কিস্তি পরিশোধ হলে তার টাকার সুদহারও সময় অুনযায়ী পুনঃনির্ধারণ করে পরিশাধের নিয়ম রয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকই বেতন, জমিজমা, দোকান ইত্যাদির বিপরীতে গ্রাহকদের ঋণ প্রদান করে থাকে। আবার ব্যাংকগুলোর এমনও পলিসি আছে যেমনঃ এক লক্ষ টাকা ঋণ নিলে বিশ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্ট দিলে একজন গ্রাহক আশি হাজার টাকা ঋণ পায় এবং বছরান্তে বা মেয়াদান্তে তাকে উক্ত আশি হাজার টাকার উপরই সুদ দিতে হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় সদস্যরা যে সঞ্চয় জমা করেন তা ডাউন পেমেন্ট হিসেবে গন্য হয় না এবং ঋণের সুদ সমুদয় ঋণের ওপর Flat Rate এ পরিশোধ করতে হয়। সুতরাং এখানেও শুভংকরের ফাঁকি দেওয়া হয় সদস্যদের ঋণ পরিশোধে।
ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় কোনো ধরনের বন্ধক ছাড়াই ঋণ দেওয়া হয় সদস্যদের সঞ্চয় ও সমিতির সভাপতি ও কিছু গ্রুপ সদস্যদের স্বাক্ষী বা স্বাক্ষীর বিশ্বাসের ওপর বিশ্বাস করে। এটাই সোশ্যালিস্ট ক্যাপিটাল। এই দরিদ্র নারী ও তার পরিবার পরিজনের বিশ্বাস যাকে আমরা Social Capital বলি তাকে পুঁজি করে এই ঋণ দেওয়া হয়। যদি কোন সদস্য ঋণ পরিশোধে অপারগ হয় তাবে ঐ জামিনদার বা স্বাক্ষী হওয়া নারী বা তাদের স্বামীরা তার বাড়িতে হানা দেয় কিস্তির জন্য। কারণ মাঠ কর্মীরা বলেন, যদি ঐ খেলাপি সদস্যের কিস্তি না দেওয়া হয় তবে ভবিষ্যতে স্বাক্ষী দেওয়া সেই সদস্যরাও আর ঋণ পাবে না। আমাদের দেশের মানুষের আত্নসম্মান বোধ অনেক বেশি। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় মানুষ না খেয়ে দিন কাটিয়েছে কিন্তু চুরি বা ডাকাতি করেনি। দরিদ্র মানুষের আত্নসম্মানবোধকে কাজে লাগিয়ে বা তাকে পুঁজি করে যুগযুগ ধরে দরিদ্র্য মানুষগুলোকে শোষণ করে যাচ্ছে এই ঋণদানকারী সংস্থাগুলোসহ গ্রামীণ ব্যাংক। এই আত্মসম্মানবোধ ব্যবহার করাটাই ঋণ আদায়ের মূল কৌশল।
একটি ঘটনা আজও আমাকে আত্নগ্লানিতে ভোগায়। ঘটনাটি হলো- আমি মাঠে বিভিন্ন সমিতিতে ভিজিট করে বেলা ১১/১২টার সময় উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮/১০ কিলোমিটার দূরে একটি প্রত্যন্ত গ্রামের একটি সমিতিতে গেলে আমার মাঠ কর্মী বলল ভাই, সমিতির একজন সদস্য ছাড়া সবাই কিস্তি দিয়েছে এবং দুটি ঋণ প্রস্তাব রয়েছে কিন্তু ঐ একজনের কিস্তি না দিলে আমি তাদের ঋণ প্রস্তাব করব না। সভাপতিসহ অন্য সদস্যরা তার বাড়িতে গেছেন কিস্তির জন্য আপনি বসেন। একটু পরেই একসাথে চলে যাব। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম কেন্দ্র বাড়িতে কর্মীর সাথে। কিছুক্ষণ পর পাশের বাড়ি থেকে তুমুল ঝগড়া বিবাদের আওয়াজ শুনা গেল এবং তা চলল প্রায় ২টা অবধি। এরপর সমিতির সভাপতিসহ বেশ কয়েকজন এসে বললেন এই নেন দুই কিস্তির টাকা। বাকি দুই কিস্তির টাকাও তাদের কাছে রেখেছেন যা পরের সপ্তাহগুলোতে দিবেন। পরে সদস্যরা বললেন ঐ সদস্যের ঘরে থাকা চৌকি বিক্রি করে তারা এই টাকার জোগাড় করেছেন! এটি শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম! এও কি সম্ভব ! পরে ঐ নারীর পাশ বইটি দেখলাম। সে এমজন আই.জি.ভি.জিডি. সদস্য একেবারেই হত দরিদ্র ভূমিহীন। এখনো সেই নারীর করুণ মুখটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। আমার মনে এখনো ক্ষতটি রয়ে গেছে। স্মৃতিকাতর হই। অপরাধবোধ কাজ করে। আরও অনেক বেদনাদায়ক ঘটনার স্বাক্ষী ক্ষুদ্র ঋণে কাজ করা কর্মীরা। গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজনকে দেখেছি তাদের দেওয়া ঘর তৈরির ঋণ পরিশোধ না করার জন্য ঘরে চালের টিন বিক্রি করতে। আশার কর্মীদের নাকের নোলক বিক্রি করতে। (প্রত্রিকার খবর ১৯৯৩) রাতে দল বেঁধে কিস্তির জন্য মহিলাদের বাড়িতে হানা দেওয়া-মধ্য রাত পর্যন্ত বাড়িতে অবস্থান করা, আরও কতো কি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।ঋণ আদায়ে লাল মোটর সাইকেলে চড়ে সংস্থার পাইক পেয়াদা বরকন্দাজে পরিণত করেছে শিক্ষিত কর্মীদের!
কালের পরিক্রমায় বর্তমানে মানুষের সামর্থ্য ও চাহিদার প্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র ঋণের ঋণ বিতরণের স্ল্যাব পরিবর্তন হয়েছে , এখন প্রথম ঋণ দশ / বিশ হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ-দশ লাখ পযর্ন্তও দেওয়া হচ্ছে। উদ্যোক্তা ও এন্টারপ্রাইজ লোনসহ বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ নিয়ে মানুষকে ঋণ দিচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকসহ, আশা, ব্র্যাক, টিএমএসএস, পদক্ষেপ, এসএসএস, বুরোসহ পাঁচ থেকে ছয়শত এনজিও । ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের কিস্তি (৪৬ সপ্তাহ), সুদ ব্যবস্থা একই রয়েছে (এক হাজার টাকায় ১৪৫ টাকা)। ২০২৪ সালে এসে প্রায় ৪ লক্ষ কোটি ঋণের পোর্টফোলিও তাদের এবং এ পুঁজির প্রায় ৬০% হলো সদস্যদের সঞ্চয়ের টাকা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বাহারি অফিস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বিভিন্ন ধরণের এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠান। প্রধান নির্বাহীদের অতি উচ্চ বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ও তাদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের একই সংস্থায় নিরাপদ চাকুরী ইত্যাদি সবই হয়েছে দরিদ্র্য নারীদের সঞ্চয় ও ঋণের সুদ থেকে। গরীব মানুষের পুঁজি ব্যবহার করে। এনজিও প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা তাঁদের বেতন ভাতা সুবিধাদি নিজেরাই সংস্থার নির্বাহী কমিটির মাধ্যমে বাড়িয়ে নেন। তারা দামী গাড়িতে চড়েন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসেন। তারা গরীব মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন করছেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে! কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশে এনজিও কার্যক্রম শুরু হয় সাদামাঠা অফিস ও আসবাবপত্র দিয়ে এবং গঠনতন্ত্রে বলা আছে জনগণের প্রয়োজন মিটে গেলে তারা সরকারের কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত হয়ে যাবেন। কিন্তু এখন তারা পুঁজিপতি হয়ে গেছেন। তাদের আর ঠেকায় কে! তবে, দেশের শিক্ষিত কিছু বেকার মানুষের চাকরি হয়েছে। এখানে এটুকুই যা পাওয়া। বাকি সব প্রশ্নবিদ্ধ উন্নয়ন!
গ্রামীণ ব্যাংককে প্রথম ফান্ড/তহবিল দেওয়া নরওয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা নোরাড ঋণের ওপর গবেষণা করে জানতে পারেন এই ঋণ নিয়ে সদস্যরা আরও গরীব ও নি:স্ব হয়েছে। তাদের দারিদ্র্য বিমোচন হয়নি। উপরন্তু গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১৯৯৮/৯৯ সালে ডঃ ইউনূস প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার (৭০০ কোটি টাকা) তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেন।
সেই সময় নরওয়ের একটি টেলিভিশনে “ক্ষদ্র ঋণের ফাঁদ” শীর্ষক একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয়। সম্ভবত ২০০৯/১০ সালে টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলায় মুন্নি সাহা একটি বড় ডকুমেন্টারি নিউজ করেছিলেন। শিরোনাম ছিল “Micro Debit” নিউজটির লিংক খুঁজে দেখতে পারেন যে কেউ । সেই ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়েছে প্রফেসর ডঃ মুহম্মদ ইউনূস এর গ্রামীণ ব্যাংক চট্রগ্রামের জোবরা গ্রাম থেকে যে নারী গ্রুপকে গৃহঋণ দিয়েছিলেন তাদের ঘরের চাল ফুটো হয়ে পানি পড়ছে। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কোনো উন্নয়ন হয়নি সে সমস্ত সদস্যদের। সেখানে গ্রামীন ব্যাংকের সদস্য, সাংবাদিক নূরুল কবির, এনজিও নেত্রী খুশী কবীর ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী একজন অর্থনীতিবিদের বিশ্লেষণ রয়েছে।
পুঁজিবাদের শোষণের হাতিয়ার আবিষ্কার করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ডঃ মোহাম্মদ ইউনূসকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করবেই তো পুঁজিবাদী বিশ্ব! পশ্চিমা পুজিবাদী বিশ্ব প্রফেসর ডঃ মোহাম্মদ ইউনূসকেই তো চায়!
নির্বাহী সম্পাদক ও প্রকাশক ঃ ইয়াসমিন আক্তার
Add A Comment