নোয়াখালীতে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ বহুমাত্রিক । ছবি: বার্তাধারা
প্রায় তিন সপ্তাহ পার হয়ে চতুর্থ সপ্তাহে পড়ল নোয়াখালীর বন্যা-পরবর্তী জলাবদ্ধতা। নতুন বৃষ্টিতে পরিস্থিতি এ সপ্তাহে আরও অসহনীয় হয়েছে। বিস্ময়করভাবে দেশের কেন্দ্র থেকে সেদিকে প্রতিকারমূলক নজর অপ্রতুল। বন্যার শুরুতে পানির আচমকা তুমুল বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ভারতীয় বাঁধের কথা বলা হয়। ত্রাণ তোলা ও বিতরণের এক গৌরবময় গণতরঙ্গও তৈরি হয়েছিল তখন। দু-চার দিন পরই উভয় ধারার উত্তেজনা থেমে গেছে।
মাঝে বৃষ্টি বন্ধ হলে পানি সামান্য একটু কমেছিল কিছু এলাকায়। এ সপ্তাহে পুনরায় বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা প্রায় আগের মাত্রায় চলে গেছে। পানি কেন কমছে না, কমানোর উপায় কী, সেসব বিষয়ে জাতীয় বা আঞ্চলিক পরিসরে কারও কোনো অর্থপূর্ণ অনুসন্ধান ও উদ্যোগ নেই আপাতত।
ক্ষতির ধরন এখানে বহুমাত্রিক। শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারাও গেছে পাল্টে। সব মিলে এই অঞ্চলের মানুষ নিকট ইতিহাসে এত বড় বিপদে পড়েনি আর। জাতীয় অর্থনীতিতে নানাভাবে বিপুল অবদান রেখেও এ জেলার মানুষ নিজেদের খুবই উপেক্ষিত ভাবছে এই মুহূর্তে। ১০ লাখের বেশি মানুষ সরাসরি পানিবন্দী।
মানুষ ত্রাণ নয়, সমস্যার কাঠামোগত সমাধান চাইছে
শুরুতে অনেক ত্রাণ গেছে নোয়াখালীতে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যরাও ত্রাণ দিয়েছে। সরকারিভাবে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে দুই দফায় শতাধিকজনকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিত্যনতুন ইস্যু ও উত্তেজনার মুখে ত্রাণ তোলা এবং সেসব নোয়াখালীতে পাঠানোর আয়োজন এখন কম।
অন্যদিকে দুর্গত এলাকার চিত্র হলো সেখানে কিছু মানুষ নতুন করে ত্রাণকেন্দ্রে যেতে শুরু করলেও সমাজ ত্রাণের চেয়েও বেশি চাইছে পানি সরানোর উদ্যোগ। মাঝের দুই সপ্তাহে বৃষ্টি তেমন হয়নি—কিন্তু পানি কমেছিল সামান্যই। অর্থাৎ পানি নামার কোনো পথ নেই অনেক ইউনিয়নে। এতে গ্রামে গ্রামে সংকট বহুমুখী চেহারা নিয়েছে।
স্বাভাবিক অর্থনীতি তছনছ হয়ে গেছে। কিছু জিনিসপত্রের জোগানও চাহিদার তুলনায় কম। দুই হাজার টাকার নৌকা চট করে ছয় হাজার টাকা হয়ে গেছে। তরিতরকারির খুব দাম। নিচুতলার বড় জনগোষ্ঠী অটোরিকশা-সিএনজিচালক ও নির্মাণশ্রমিকদের হাতে একদম টাকা নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিপুল নির্মাণশ্রমিক থাকেন এই জেলায়। তাঁরা কর্মহীন হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কৃষির মধ্যে মৎস্য ও মুরগির খামারিরা প্রায় সবাই সর্বস্বান্ত। এ রকম স্থানীয় মানুষেরা বলছেন, গতানুগতিক ত্রাণে এ সমাজে স্বস্তি ফিরবে না। দ্রুত জলাবদ্ধতার নিরসনই মানুষকে স্বপুনর্বাসনের সুযোগ করে দিতে পারে। কিন্তু সে বিষয়ে জোরালো দাবি তোলার মতো রাজনীতি নেই, প্রশাসনিক উদ্যোগও সীমিত।
যে কারণে পানি সরছে না
প্রায় আটটি উপজেলার মানুষ এখানে জলবন্দী। স্থানীয় লোকজন স্বীকার করেন, এ সংকটের কাঠামোগত দিকটি স্থানীয়ভাবেই তৈরি। কিন্তু তার জট খুলতে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ লাগবে। এ জেলাজুড়ে একসময় প্রচুর খাল ছিল, যা ছিল পানিনিষ্কাশনের প্রাচীন উপায়। এখানে অতীতেও প্রচুর বৃষ্টি হতো। খালগুলো সেই বৃষ্টির পানি ধরে রাখত এবং নদী হয়ে সমুদ্রে চলে যেতে সাহায্য করত। কিন্তু পানি চলাচলের পুরোনো পথ খালগুলো ভরাট করে বাড়িঘর-দোকানপাট তোলা হয়েছে দশকের পর দশক ধরে। বিপুল প্রবাসী আয় আসতে থাকায় নোয়াখালীতে দুই দশক ধরে নির্মাণকাজের জোয়ার বইছে। মাঠঘাট-জলাশয় ভরাট করে বাড়িঘর বানানো হয়েছে পানিনিষ্কাশনের ব্যাপারটা না ভেবেই।
কোথাও কোথাও খাল ভরাট করে রাস্তা তৈরি হয়েছে। খালের দুই দিক আটকে মাছের খামার বানানো হয়েছে। বাকি খালগুলো ভরাট হয়ে কৃষিজমির চেহারা নিয়েছে। পতিত খাল প্লাস্টিকসহ নানান শক্ত বর্জ্যের বিশাল ভাগাড় হয়ে আছে। ফলে এ বছর যে দুর্যোগ হলো, সেটা নোয়াখালীতে আগে-পরে হতোই। বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী, চাটখিলের এ রকম দুর্যোগ দীর্ঘ ভারী বৃষ্টি হলে অন্য জেলাগুলোতেও হবে। একই রকম কাঠামোগত অনাচার ওসব দিকেও চলছে।
নোয়াখালীতে এ মুহূর্তে দরকার কঠোর প্রশাসনিক উদ্যোগে খালগুলো উদ্ধার। যেহেতু এ রকম কাজে অনেক সময় লাগবে, সে জন্য শুরুতে বিভিন্ন স্থানে খালের মুখ দখল করে বানানো অবকাঠামোগুলো সরানো যেতে পারে। স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রশাসনই কেবল এ কাজ করতে পারে।
নোয়াখালীতে এ মুহূর্তে দরকার কঠোর প্রশাসনিক উদ্যোগে খালগুলো উদ্ধার। যেহেতু এ রকম কাজে অনেক সময় লাগবে, সে জন্য শুরুতে বিভিন্ন স্থানে খালের মুখ দখল করে বানানো অবকাঠামোগুলো সরানো যেতে পারে। স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রশাসনই কেবল এ কাজ করতে পারে।
মাইজদী ও চৌমুহনীর বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকেই বলছেন, ভারতের ড্যামের অতিরিক্ত পানি কুমিল্লা-নোয়াখালীর বন্যায় এবার বাড়তি উপাদান যুক্ত করলেও এখনকার চলমান জলাবদ্ধতার সংকট পুরোই স্থানীয় চরিত্রের। এর সমাধানও তাই স্থানীয়ভাবেই খুঁজতে হবে এবং সেই সমাধান হলো খালের জালসমূহের কাঠামোগত পুনরুদ্ধার।
২০১৯ সালে এ রকম একটা উদ্যোগ শুরু হলেও তাতে প্রতিকার হয়েছে অল্প। সামান্য কয়টা এলাকায় কিছু খাল উদ্ধার হয় তখন। এ কাজে অর্থও ছিল অপ্রতুল। কাজের বিভিন্ন দিক ঠিকাদারদের দিয়ে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় নজরদারির ঘাটতিতে পড়েছিল। খালের মাটি পাশে উঁচু করে এমনভাবে রেখে দেওয়া হয় যে এবারের ভারী বৃষ্টিতে সেসব মাটি গিয়ে ওই খননকৃত খালগুলোও অনেকখানি ভরাট হয়ে গেছে।
দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় বহু জায়গায় উদ্যোগটি স্থানীয় দখলদারদের বাধায় পড়েছিল তখন। যেহেতু বহু জায়গায় খালের দখলদারেরা প্রভাবশালী, সে কারণে অবকাঠামোগত পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে বিপুলভাবে সঙ্গে নিয়ে। এবারও জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকার উদ্যোগ নিয়েও দখলকারীদের বাধায় খাল থেকে নদীমুখী পানি সরার কয়েকটি জায়গা উদ্ধার করতে পারেননি। সশস্ত্র বাহিনীর দৃঢ় সহায়তা ছাড়া এ কাজে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এ রকম যেকোনো উদ্যোগে জনবল ও অর্থ বিনিয়োগের আগে এই এলাকার জলপথগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বিশেষজ্ঞদেরও জরুরি ভিত্তিতে মতামত নেওয়া দরকার। এভাবে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি খালের অন্তত ৩০০ কিলোমিটারের একটা নেটওয়ার্ক উদ্ধার করা না গেলে এককালের সমৃদ্ধ এই জেলা দ্রুত প্রাণ-প্রকৃতির চরম বিপর্যয়ে পড়বে, যার আলামত ইতিমধ্যে স্পষ্ট।
- জামাল লেখক জলাবদ্ধতার শিকার নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বাসিন্দা